ফেনীতে শিশু আহনাফ হত্যায় যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে, তাদের একজন আশ্রাফ হোসেন চৌধুরী ওরফে তুষার (২০)। শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন তিনি।
আশ্রাফ নিহত আহনাফের বড় ভাইয়ের বন্ধু। আহনাফ নিখোঁজ হওয়ার পরদিন থেকেই তার সন্ধান চেয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কটি পোস্ট শেয়ার করেন আশ্রাফ। আহনাফকে উদ্ধারের বিষয়ে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করে ও মুঠোফোনে পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।
পুলিশের দাবি, বৃহস্পতিবার দুপুরে লাশ উদ্ধার হলেও ৮ আগস্ট রাত দুইটা থেকে তিনটার মধ্যে আহনাফকে খুন করেন আশ্রাফ চৌধুরীসহ তিন যুবক। অথচ এর পরদিন থেকে হত্যায় অভিযুক্ত আশ্রাফ হোসেন চৌধুরী ফেসবুকে আহনাফের সন্ধান চেয়ে একাধিক পোস্ট করেন। তার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়ে দেখা যায়, আহনাফের সন্ধান চেয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির অন্তত তিনটি পোস্ট আশ্রাফ শেয়ার করেছেন। এসবের মধ্যে আহনাফের বাবার পোস্টও রয়েছে।
একটি পোস্ট শেয়ার করার সময় আশ্রাফ লিখেছেন, “আল্লাহ আপনার রহমতের উসিলায় আমাদের ছোট ভাইটাকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন।”
আরেকটি পোস্ট শেয়ারের সময় লিখেছেন, “আপনারা কেউ যদি আমার ছোট ভাইটার সন্ধান পেয়ে থাকেন, তাহলে অতি দ্রুত যোগাযোগ করুন।”
বৃহস্পতিবার দুপুরে সদর উপজেলার দেওয়ানগঞ্জ রেললাইনের পাশের ডোবা থেকে স্কুলশিক্ষার্থী আহনাফের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে ফেনী গ্রামার স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
এর আগে ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিখোঁজ হয় আহনাফ।
পুলিশ জানায়, ৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় শহরের একাডেমি এলাকার আতিকুল আলম সড়কের লাইট হাউসে কোচিং শেষ করে স্থানীয় বায়তুল খায়ের জামে মসজিদে নামাজ পড়তে যায় স্কুলশিক্ষার্থী আহনাফ। নামাজ শেষে বাসায় ফেরার পথে তাকে দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে দেওয়ানগঞ্জ এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে চেতনানাশক দিয়ে তাকে অচেতন করা হয়। অপহরণকারীরা আহনাফের ছবি তুলে তার বাবা মাঈন উদ্দিনের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। টাকা দিতে বিলম্ব হওয়া এবং আহনাফকে ছেড়ে দিলে অপহরণকারীরা ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কায় তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে দেন হত্যাকারীরা। লাশ লুকাতে আহনাফের স্কুলব্যাগে ভরা হয় রেললাইনের পাথর।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আহনাফ নিখোঁজ হওয়ার পর আশ্রাফের অতি উৎসাহী হয়ে খবর নেওয়া ও পরামর্শ দেওয়া আহনাফের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সন্দেহ জাগায়। একপর্যায়ে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করে দিতে আহনাফের বাবাকে আশ্রাফ পরামর্শও দেন। সন্দেহের বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করা হলে পুলিশ আশ্রাফকে আটক করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে তিনি খুনের বিষয়টি স্বীকার করেন। তাঁর তথ্যের ভিত্তিতে আরও দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তার আশ্রাফ ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের প্রথম বর্ষের ছাত্র। তিনি জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের নিজপানুয়া গ্রামের ইকবাল হোসেন চৌধুরীর ছেলে। তবে শহরের সালাহ উদ্দিন মোড় এলাকায় বসবাস করে আসছেন।
নিহত আহনাফের বাবা মাঈন উদ্দিন বলেন, আহনাফকে অপহরণ করে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ১২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। পরদিন আশ্রাফ তাঁকে বিভিন্ন পরামর্শ দেন নিখোঁজ আহনাফকে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। একাধিকবার তাঁকে ফোন করেন এবং দেখা করে বিভিন্ন পরামর্শ দেন। একপর্যায়ে মুক্তিপণ দিয়ে দিতেও অনুরোধ করেন।
জেলা পুলিশ সুপার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, যে হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে মুক্তিপণ চাওয়া হয়, সেটির সন্ধান পেতে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে এক নারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই নারী জানান, ৫ আগস্ট একটি ঘর থেকে তাঁর মোবাইল লুট হয়। তিনি আর সেই ফোনটি ফিরে পাননি।
হাবিবুর রহমান বলেন, অপহরণকারীরা লুট হওয়া সেই ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর দিয়ে আহনাফের বাবার কাছে মুক্তিপণ দাবি করেছিলেন। মুক্তিপণের টাকা দিতে দেরি হওয়ায় এবং জানাজানি হওয়ার ভয়ে আহনাফকে শ্বাস রোধ করে হত্যা করে লাশ রেললাইনের পাশে ডোবায় ফেলে দেন।
ফেনী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মর্ম সিংহ ত্রিপুরা বলেন, আহনাফকে হত্যার পরও মুক্তিপণ হিসেবে দাবি করা টাকা আদায়ে তার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছিলেন আশ্রাফসহ খুনিরা। তারা তিনজন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। আদালতেও তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আশ্রাফ ছাড়া গ্রেপ্তার অপর দুই আসামি হলেন মো. মোবারক হোসেন ওয়াসিম (২০) ও ওমর ফারুক রিফাত (২০)।
আশ্রাফ জেলায় ছাত্রদলের রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। ছাত্রদল ও যুবদলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তার অংশগ্রহণের ছবিও ফেসবুকে রয়েছে। জানতে চাইলে জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মোরশেদ আলম বলেন, “আশ্রাফের দলীয় কোনো পদ–পদবি নেই। সে শুধু কর্মী। পদ-পদবি থাকলে তার বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেত। তার অপরাধের দায় কোনোভাবেই সংগঠনের ওপর পড়ে না।”