লালমনিরহাটে মামলা জটিলতায় আদালতের নির্দেশে আবাসন নির্মাণ কাজ স্থগিত থাকায় দীর্ঘ ৮ মাস ধরে খোলা আকাশের নিচে ৭০টি পরিবার। পুরোনো আবাসনের জরাজীর্ন ঘর ভেঙে নতুন করে আশ্রয়নের ঘর নির্মাণ শুরু করা হলে আরতি রানী নামে এক নারী আবাসনের জমির মালিক দাবি করে আদালতে মামলা দিলে ঘর নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।
আবাসনে থাকা সুফল ভোগী ৭০ পরিবারের কেউ অন্যের বাসা-বাড়ির উঠানে, রাস্তার ধারে, বাঁশ ঝাড় আবার কেউ পুকুর পাড়ে পলিথিন সাঁঠিয়ে চরম মারবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। দীর্ঘ ৮ মাস ধরে তীব্র শীত উপেক্ষা করে খোলা আকাশে পরিবার পরিজন নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন এসব পরিবার।
জানা গেছে, লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার পলাশী ইউনিয়নের মদনপুর গ্রামের ভুমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ২০০৩-২০০৪ অর্থ বছরে আবাসান নির্মাণ করে সরকার। সে সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওই গ্রামের সরকারী খাস জমিতে ৭০টি পরিবারের জন্য টিনসেড ঘর তৈরি করে দেন। সেই থেকে আবাসনে বসবাস করে আসছেন ৭০টি ভুমিহীন পরিবার।
পরে মেরামতের অভাবে আবাসনটির ছাউনীর টিন নষ্ট হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিলেও বরাদ্ধ না থাকায় সংস্কার করা হয়নি। একপর্যায়ে সুফলভোগীদের দুর্ভোগ বিবেচনা করে আবাসন সংস্কার না করে আবাসনের জমিতে আশ্রয়ন প্রকল্পের ঘর করে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এরপর গত অর্থবছরে বরাদ্ধ পেলে ৭০ পরিবারকে পুনর্বাসন করতে নতুন করে আশ্রয়নের ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। নতুন করে ঘর নির্মাণ করতে পুরাতন ঘর সড়াতে বলা হলে সুফলভোগীরা যে যার যার মতো তাদের জিনিসপত্রসহ ঘর ভেঙে জায়গা ফাঁকা করেন।
ওই সময় আবাসনে থাকা সুফল ভোগী ৭০ পরিবার অন্যের বাসা-বাড়ির উঠানে, রাস্তার ধারে, বাঁশ ঝাড়, পুকুর পাড়ে পলিথিন সাঁঠিয়ে অস্থায়ী বসবাস শুরু করেন। কথাছিল আড়াই মাসের মধ্যে আশ্রয়নের ঘর নির্মাণ শেষ হলে তারা পুনরায় ফিরবেন নতুন ঘরে। পরে নতুন করে আশ্রয়ন করতে গত জুলাইয়ে কাজ শুরু করে উপজেলা প্রশাসন।
এদিকে আবাসনের জমি ফাঁকা হলে সুযোগ বুঝে জমি নিজের দাবি করে কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা গ্রামের মৃত শিশির কুমারের স্ত্রী আরতি রানী বাদি হয়ে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন। ভুমি মন্ত্রনালয়ের সচিব, জেলা প্রশাসকসহ ৫ জনকে বিবাদি করা হয় মামলায়।
ওই মামলায় গত অক্টোবরের ৮ তারিখ নির্মাণ কাজের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন উচ্চ আদালত। এ কারণে আশ্রয়ণ নির্মাণ কাজ শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আবাসন থেকে সড়ে যাওয়া ৭০ পরিবার পড়েছেন বিপাকে।
সুফল ভোগী ৭০ পরিবার গত বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে ঘুমহীন রাত কেটিয়েছেন। বর্তমানে শীতের ঘন কুয়াশা আর কনকনে ঠান্ডায় পলিথিন সাঁটানো ঝুপড়ি ঘরে থেকে নিদারুন কষ্ট পোহাচ্ছেন। তারা বৃষ্টি শীত উপেক্ষা করে দীর্ঘ ৮ মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
এদিকে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত কবে হবে? কবে আশ্রয়নের ঘর নির্মাণ হবে? এ নিয়ে কপালে চিন্তায় ভাঁজ পড়েছে ভুমিহীনদের।
ভুক্তভোগী সহিজন বেওয়া (৯০) বলেন, “আগে আবাসনের ঘরে টিনে ফুটো থাকলেও পলিথিনে মুড়িয়ে থাকতাম। নতুন ঘর করে দেওয়ার কথা বলে সব ভেঙে দিল ইউএনও স্যার। অন্যের জমিতে ২ মাসের কথা বলে টিনের ছায়লা পেতে আছি। এখন ৮ মাস পরিয়ে যাওয়ায় জমির মালিক থাকতে দিচ্ছে না। এখন কোথায় যাব?”
ভুক্তভোগী আর্জিনা বেগম বলেন, “জুন মাসে আবাসন ভেঙে দিয়েছে। দুই মাসের মধ্যে নতুন করে ঘর করে দেওয়ার কথা। আট মাস হচ্ছে, এখন পর্যন্ত নতুন ঘর নির্মাণ শুরুই করেনি। দুই মাসের জন্যে অন্যের বাড়ির বারান্দায় পলিথিনের ঘর বানিয়ে কোনো রকম করে আছি। তারাও আর থাকতে দিচ্ছে না। সন্তানদের নিয়ে এখন কোথায় যাই।”
মোফাজ্জল মিস্ত্রী বলেন, “দুই মাসের জন্য পাশের এক জমি মাসে ৫ হাজার টাকা ভাড়া নিয়ে টিনের ছায়লা করেছি। দুই মাসের স্থলে ৮ মাস হলো। ৪০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হলো। নতুন ঘরও হচ্ছে না। মাসে ৫ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে চলা আমার কষ্ট হচ্ছে।”
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আলাউল ইসলাম ফাতেমী পাভেল বলেন, “আবাসনের ৭০ পরিবারের দুর্ভোগ লাগবে দ্রুত সমাধান করতে উপজেলার প্রতিটি সভায় বিষয়টি তুলে ধরেছি। এ এলাকায় এমন কোনো পরিত্যক্ত বা খাস জমি নেই যেখানে এসব পরিবারকে অস্থায়ীভাবে স্থানান্তর করা যায়। তারা বিভিন্নভাবে অন্যের বাড়িতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে চলতি মাসে এর সমাধান আসবে বলে শুনেছি।”
উপজেলা আশ্রয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুর ই আলম সিদ্দিকী বলেন, “দীর্ঘদিনের পুরাতন আবাসনটি জরাজীর্ন হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছিল। তাই সেটি ভেঙে আশ্রয়নের ঘর করে ওই ৭০ পরিবারকে পুনর্বাসন করতে আশ্রয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। দ্রুত কাজ শেষ করতে জুলাইয়ে কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু পরবর্তিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছে। খুব দ্রুত এর সমাধান হবে বলে আশা করছি।”