• ঢাকা
  • রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫

মুক্তিযোদ্ধার ৭ ভুয়া সন্তান, কোটায় চাকরি পেলেন ৫ জন


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১২, ২০২৪, ০৫:৩৯ পিএম
মুক্তিযোদ্ধার ৭ ভুয়া সন্তান, কোটায় চাকরি পেলেন ৫ জন

সারা দেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। ঠিক সেই সময় সবার সামনে এসেছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার বিরল পিতৃত্বের ঘটনা। নিজের ঔরসজাত সন্তান দুজন। তবে টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি কোটা ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে তিনি আরও সাত সন্তানের বাবা হয়েছেন। নিজের সনদ অপব্যবহার করে এদের মধ্যে পাঁচজনকে দিয়েছেন সরকারি চাকরি।

আর এভাবে বাবা সেজে রাতারাতি লাখ লাখ টাকা কামিয়েছেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার (রানীরপাড়া) বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। রফিকুল ইসলাম সোনাতলা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডারও।

শুক্রবার (১২ জুলাই) এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম শীর্ষ গণমাধ্যম দৈনিক সমকাল।

অনুসন্ধানে জানা যায়, রফিকুল ও রেবেকা সুলতানা দম্পতির সন্তান রাশেদা আক্তার ও মোর্শেদা আক্তার। দুজনই এখন গৃহিণী। তবে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির সন্তানকে নিজের দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি ও অন্যান্য সুবিধা আদায় করে দিয়েছেন রফিকুল। এ জন্য সুবিধাপ্রাপ্তদের কাছ থেকে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে অন্তত অর্ধকোটি টাকা হাতিয়েছেন রফিকুল। সামনে আসা সাতজনের বাইরেও তার সনদ ব্যবহার করে কয়েকজন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি করছেন বলে জানা গেছে।

রফিকুলের ভুয়া সন্তান হলেন– দুই ভাই আহসান হাবিব হান্নান ও জিয়াউর রহমান, বেলাল হোসেন, ফরহাদ হোসেন, সালেক উদ্দিন, রাকিব হাসান ও মৌসুমী আক্তার। তাদের মধ্যে হান্নান ও জিয়াউরের প্রকৃত বাবা সোনাতলার দক্ষিণ রানীরপাড়ার জাফর আলী। হান্নান চলতি বছর রফিকুলের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহার করে চাকরি পান এবং বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা পুলিশের রিজার্ভ ফোর্সে কর্মরত (মামলার পর সাময়িক বরখাস্ত)। আর সনদের মাধ্যমে জিয়াউরকে সারের ডিলারসহ নানা ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছেন রফিকুল।

বেলালের আসল বাবা প্রয়াত জবেদ আলীর বাড়ি উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ায়। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তিনি কনস্টেবলের চাকরি পান ২০০১ সালে। ঢাকা মহানগর পুলিশের শাহবাগ ট্রাফিক জোনের এটিএসআই বেলালকে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ।

ফরহাদ হোসেনের প্রকৃত বাবা সোনাতলার ক্ষিতারেরপাড়ার জাহিদুল ইসলাম। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে চাকরি করছেন ফায়ার সার্ভিসে। অভিযোগের পর গাইবান্ধার ফুলছড়ি ফায়ার সার্ভিস থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া রফিকুলের সনদ নিয়ে উপজেলার ক্ষিতারেরপাড়ার নায়েব আলীর ছেলে সালেক কনস্টেবল হন ২০০৫ সালে। সোনাতলার পাশের জুমারবাড়ী এলাকার মৌমিনুল ইসলামের ছেলে রাকিব চাকরি করছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরে। আর ভাই শহীদুল ইসলামের মেয়ে মৌসুমী আক্তারকে নিজের মেয়ে সাজিয়ে তিন বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি করেন রফিকুল।

স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, রফিকুলের সন্তান সাজিয়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার কারবার বেশ পুরোনো। মুক্তিযোদ্ধার সাইনবোর্ডের আড়ালে তিনি নানা অপকর্মে লিপ্ত। এসব দেখে ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেন উপজেলার রানীরপাড়ার কেল্লাগাড়ী গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও নিমেরপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, এক স্ত্রী ও দুই মেয়ে রফিকুলের। অথচ তিনি অন্তত সাতজনকে সন্তান সাজিয়ে চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন ও আবদুস সাত্তার জানান, রফিকুল প্রতারক। অন্যের সন্তানকে নিজের দেখিয়ে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে চাকরি পেতে সহায়তা করেন। রফিকুল ও তার সনদে যারা চাকরি পেয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানান তারা।

অভিযোগের পর মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে। দু’বছরে ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় দুদক বগুড়ার সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান গত ৩০ জানুয়ারি রফিকুল ও তার তিন ভুয়া সন্তানের বিরুদ্ধে পৃথক মামলা করেন।

এক এজাহারে বলা হয়, রফিকুল ও বেলাল যোগসাজশে মুক্তিযোদ্ধার সনদে চাকরি নিয়ে এ পর্যন্ত ৫০ লাখ ১৮ হাজার টাকার বেশি সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। অন্য দুই মামলায় একইভাবে হান্নানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের ৫০ লাখ ১৮ হাজার ও ফরহাদের বিরুদ্ধে ৩২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়।

দুদকের সহকারী পরিচালক জাহিদ হাসান বলেন, অনুসন্ধানে রফিকুল ও তিনজনের জালিয়াতির সত্যতা পাওয়া গেছে। অন্যদের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।

এক সন্তান ফরহাদের বাবা জাহিদুল ইসলাম বলেন, “জন্মের পর আমার ছেলেকে দত্তক নেন রফিকুল। লেখাপড়া ও ভরণপোষণ দিয়ে তিনি বড় করে মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি পেতে সহায়তা করেছেন। এতে দোষের কী আছে?”

মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল বলেন, “পালক হলেও তারা আমার নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আমি তাদের মানুষ করেছি। পরে চাকরি পেতে সহায়তা করেছি।” মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, “আদালতে মোকাবিলা করব। এ নিয়ে বিচলিত নই।”

Link copied!