• ঢাকা
  • রবিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দিনাজপুরে ১৭২৬টি গণহত্যা, বধ্যভূমির অধিকাংশই অরক্ষিত


বিজন কুমার, দিনাজপুর
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩০, ২০২২, ০৫:২৭ পিএম
দিনাজপুরে ১৭২৬টি গণহত্যা, বধ্যভূমির অধিকাংশই অরক্ষিত

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার ৫১ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু এত বছরেও অনেক গণহত্যার স্থান এখনো অরক্ষিত। শুধু তা-ই নয়, অনেক বধ্যভূমি, গণকবর এখনো সঠিকভাবে চিহ্নিত হয়নি। অনেক স্থানই আজ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। গবেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঁচিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন এসব স্থান সংরক্ষণ করা। তবেই সম্ভব মুক্তিযুদ্ধের ব্যপকতা বর্ণনা করা। সম্ভব কতটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে এ দেশের মানুষ, তার বর্ণনা দেওয়া।

উত্তরের জেলা দিনাজপুর। সাম্প্রতিক সময়ে এই জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা এবং জরিপের কাজ হয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন গবেষক হলেন দিনাজপুর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল বিশ্বাস। মোজাম্মেল বিশ্বাসের জরিপে দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় শুধু গণহত্যার সংখ্যাই দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭২৬টি। এ ছাড়া বধ্যভূমি ৩২টি, গণকবর ৩৪টি, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর ১০টি এবং নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা পাওয়া গেছে প্রায় ৬৫টি। যার অধিকাংশই এখনো অরক্ষিত।

গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের সহযোগিতায় তিনি এই জরিপকাজ সম্পন্ন করেন। জরিপ শেষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে লিখেছেন গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ নামে একটি গ্রন্থ। যেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনা। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তানি দখলদার কিংবা তাদের অনুচরদের চোখে যে বাঙালিই পড়েছে তিনি আর জীবন বাঁচাতে পারেননি।

দিনাজপুর সদর উপজেলায় মোট ৪৬৮টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সবার প্রিয় ছিল মনুদা। প্রথমে তার দুই চোখ উপড়ে ফেলে আলবদর বাহিনীর লোকেরা। পরে চলে অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন। অবশেষে তিনি শহীদ হন। এ ছাড়া জেলা শহরের অন্যতম শিশুগণহত্যার মূলকেন্দ্র ছিল টেলিফোন ভবন। শিশুদের শূন্যে ছুড়ে বেয়নেটে গেঁথে এই ভবনে হত্যা করা হতো শিশুদের। আর পাকিস্তানি সেনারা সেই সময় চিৎকার করে বলত ‘এ হি হায় জয় বাংলা।’ এ ছাড়া সদর হাসপাতাল, উপজেলার মাঝাডাঙ্গা, গোদাগাড়ি, গোসাইপুর, দাড়াইল, রামপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পাকিস্তানি হানাদাররা।

জেলার সবচেয়ে বেশি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে পার্বতীপুর উপজেলায়। তৎকালীন সময়ে পার্বতীপুর রেলস্টেশনে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কয়েকটি কয়লার ইঞ্জিন দাঁড়িয়ে থাকত শুধু মানুষ পোড়ানোর কাজে। সন্ধ্যার পরে রেলের সেই ইঞ্জিনে জ্বলন্ত বয়লারে নিক্ষেপ করে গণহত্যা চালাত পাকিস্তানিরা। আর যাদের সম্ভব হতো না তাদের কেটে বয়লারে নিক্ষেপ করা হতো। এই  উপজেলায় মোট গণহত্যার সংখ্যা ৫১৩টি।

যুদ্ধের সময় দিনাজপুরের বিরল উপজেলার কামদেবপুর এলাকায় বিভিন্ন সময় টহল দিত পাকিস্তানি বাহিনী। এই এলাকায় গণহত্যা হয় ১৯৭১-এর ৫ জুন ১১ জনকে স্থানীয় একটি শালবাগানে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনীরা। পরে সন্ধ্যায় সেখানে তারা ধরে নিয়ে যাওয়া ৮ জনকে গুলি করে মারে। অনেকেই আহত হয়ে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া এই উপজেলায় বহলা, বড় বৈদ্যনাথপুর, পশ্চিম রাজারামপুর, বুনিয়াদপুর, ভা-ারা সরকারপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মোট গণহত্যা সংঘটিত হয় ১৩৮টি।

গবেষকের মতে, ঘোড়াঘাট উপজেলায় মোট গণহত্যার সংখ্যা ১১৯টি। এর মধ্যে একটি গণহত্যার স্থান হলো ডাকবাংলো গণহত্যা। এখানে ১০ দিনে প্রায় দেড় শ জন মানুষ গণহত্যার শিকার হয়। এ ছাড়া লালদহ বিল, বলাহার, ডুগডুগিহাট, মাঝিপাড়া, রানিগঞ্জে গণহত্যা সংঘটিত হয়।

জেলার চিরিরবন্দর উপজেলার নওখৈড় গ্রামের কামারপাড়ায় এলাকায় ২০ জনকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। ওই দিন ভোরে এলাকার বাড়ি-ঘুরে আগুন এবং গুলিবর্ষণ করে এলাকায় তারা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। এ ছাড়া এই উপজেলার উচিৎপুর, ভূষিরবন্দর, কাওগাঁ রেলস্টেশন, বাণীযোগী, কাঁকড়া রেলব্রিজ এলাকায় মোট ১০৭টি  গণহত্যা সংঘটিত হয়।

এর বাইরে ফুলবাড়ীতে ৭৮টি, বোচাগঞ্জে ৭২টি, হাকিমপুরে ২৬টি, বীরগঞ্জে ১৩টি, খানসামায় ১০টি, নবাবঞ্জে ৭টি এবং কাহারোলে ৬টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।  

জরিপসংক্রান্ত কাজের বিষয়ে দিনাজপুর সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ মোজাম্মেল বিশ্বাসের সঙ্গে কথা। তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিলুপ্তি প্রায় ইতিহাস। এই ইতিহাস তুলে নিয়ে আসতে পারলে গণহত্যায় বাঙালির শেষ পরিণতি কী হয়েছিল, তা তুলে আনা সম্ভব। স্বাধীনতার অনেক বছর হলো। সংরক্ষণের অভাবে অনেক স্থান অরক্ষিত। এখনো খুঁজলে হয়তো গণহত্যা, বধ্যভূমি কিংবা গণকবরের সংখ্যা আরও  বৃদ্ধি পাবে। অনেক স্থানেই এখনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হয়নি। সরকার এবং সংশ্লিষ্টদের কাছে আমাদের অনুরোধ স্থানগুলো যেন সংরক্ষণ করা হয়। তবেই নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা সম্ভব।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল হক ছুটু বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলো। সবার আগে প্রয়োজন চেতনা। আজকে আমরা ২১ ফেব্রয়ারিতে দেখি ডান হাতে ফুল আর বাঁ হাতে জুতা নিয়ে শহীদ মিনারে উঠতে। তাহলে আজকে চেতনা কোথায়। তাহলে জুতা আর ফুলের স্থান একই হলো। এই বাংলাদেশ নিয়শ্চই আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধু প্রত্যাশা করেননি। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের মূল্যে কেনা এই দেশে আমাদের চেতনার কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসে। আসলে হৃদয়ে কেউ লালন করে না। অনেক স্থানই আজকে সংরক্ষণ হয়েছে। সেখানে স্মৃতিসৌধও নির্মাণ হয়েছে। কিন্তু সঠিকভাবে সংরক্ষণ হয়নি। দেখা গেছে পরে সেখানে গরু ছাগল বাঁধার জায়গা হয়েছিল। সেটা যেন না হয়। প্রকৃত অর্থে নির্মাণ করে যেন সংরক্ষণ করা হয়। আমি নিয়শ্চই মনে করি অরক্ষিত স্থান সংরক্ষণ করে সেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হোক।

দিনাজপুর সম্মলিতি সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সুলতান কামাল উদ্দীন বাচ্চু সংবাদ প্রকাশকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এরমধ্যে পার্বতীপুর উপজেলার কথা না বললেই নয়। এই উপজেলাটি ছিল যুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট (স্থান)। তবে এখন পর্যন্ত সংখ্যাগুলো এলোমেলো। যার ফলে গণহত্যা, গণকবরের স্থানগুলো নিরূপণ করা আমাদের জন্য এখনও কঠিন। পার্বতীপুরে গণহত্যার যে ৫ শতাধিক গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। তার সংখ্যা আরও বেশি হবে বলে মনে করছি। বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম যারা কাজ করছে। তাদের গবেষণায় সত্যি আমরা হতবাক। তাদের গবেষণায় অনেক গণহত্যার সংখ্যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যাগে এখন পর্যন্ত যেসব স্থান চিহ্নিত হয়েছে। সেখানে সঠিকভাবে স্মৃতিসৌধ নির্ণয় করা হয়নি। আমরা আশা করি যারা গবেষণা করছেন এবং স্থানগুলো চিহ্নিত হচ্ছে, অবশ্যই তাদের গবেষণা এবং চিহ্নিতস্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ সরকারি পৃষ্ঠপোশকতার মধ্যে দিয়ে করা হবে।    

এ বিষয়ে কথা  হলে পার্বতীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইসমাঈল বলেন, “আমাদের পার্বতীপুর উপজেলায় যে বধ্যভূমিটি রয়েছে, সেখানে বিভিন্ন দিবসসমূহে শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে যথাযোগ্য মর্যদা প্রদান করি। যতটুকু আমাদের নজরে রয়েছে ততটুকু আমরা যথাযোগ্য মর্যদা প্রদানের ব্যবস্থা করি।”
 

Link copied!