বিদেশী জাতের ব্যানানা চাষ করে এ বছর যুক্তরাজ্যে রপ্তানি করে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছেন নওগাঁর সোহেল রানা। বিভিন্ন জাতের আম বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয় অনেক আগে থেকেই। কিন্তু এ বছরই প্রথম ব্যানানা ম্যাংগো রপ্তানি করা হয়েছে নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার সোহেল রানার ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা ‘বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক’ থেকে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৯ সালে পরিসংখ্যান বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করেন সোহেল রানা। পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতা। কিন্তু সাংবাদিকতা পেশা সোহেল রানার ভালো লাগেনি। তার মন পড়ে ছিল কৃষি খামারে। তাই সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ২০১৪ সালে তিনি নওগাঁ জেলার সাপাহার উপজেলার নিজ গ্রাম রূপগ্রামে নিজের ১২ বিঘা জমি নিয়ে গড়ে তোলেন ‘রূপগ্রাম অ্যাগ্রো ফার্ম’। এই ফার্মে আম, বরই, পিয়ারাসহ বিভিন্ন জাতের ফলমূলের বাগান গড়ে তোলেন। দেখতে পান সফলতার হাতছানি। এই ফার্মের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে ২০১৮ সালে নিজের জমি ও অন্যের কাছ থেকে লিজ নেওয়া জমি সবমিলিয়ে প্রায় ১৫০ বিঘা জমির উপর গড়ে তোলেন ‘বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্ক’ নামের একটি সমন্বিত কৃষি খামার। এই সমন্বিত খামারে রয়েছে প্রায় ৩০০ জাতের বিভিন্ন ফলমূল, ঔষধি, মসলা জাতীয় গাছ। মাছ চাষের জন্য রয়েছে বেশ কয়েকটি বড় পুকুর। বিভিন্ন পুকুরে রয়েছে বিভিন্ন জাতের ও আকারের মাছ। রয়েছে বিভিন্ন জাতের পাখির খামার।
বরেন্দ্র অ্যাগ্রো পার্কের প্রতিষ্ঠাতা জানান সোহেল রানা, বেশ কয়েক বছর আগে নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় হার্টিকালচারে ‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদন’ শীর্ষক এক প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছিলাম। ঐ প্রশিক্ষণে আমি ব্যানানা ম্যাংগো সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি। তারপর থেকেই এই জাতের আম বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদনের জন্য চিন্তা ভাবনা করতে থাকি। অবশেষে ২০১৮ সালে ঠাকুরগাঁও জেলার একটা নার্সারি থেকে ৫০০ ব্যানানা ম্যাংগো গাছের চারা সংগ্রহ করে নিজের খামারে রোপণ করি। পরে আরও ৫০০ চারা বগুড়া থেকে সংগ্রহ করে রোপণ করি। ২০২০ সালে আমার ব্যানানা ম্যাংগো গাছে প্রথম ফল আসে। কিন্তু সে বছর গাছের আম না নিয়ে মুকুল ভেঙে দেই। এ বছর ব্যানানা ম্যাংগো গাছে আশাতীত ফল ধরেছে। প্রতিটি গাছে গড়ে ৮ থেকে ১৫ কেজি আম ধরেছে। আমগুলো আগে থেকেই ব্যাগিং করা হয়েছিল। অর্ডার অনুযায়ী ৭ জুলাই বরেন্দ্র অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে ৫০০ কেজি ব্যানানা ম্যাংগো যুক্তরাজ্যে রপ্তানির উদ্দেশ্যে নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্যামপুরে পাঠিয়েছি। সেখানে রপ্তানির জন্য যে সব প্রক্রিয়া বা ধাপ অনুসরণ করতে হয় সে ধাপ অনুসরণ করে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রথম ব্যানানা আম রপ্তানি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের আমদানীকারক আমগুলো পেয়ে খুব ভালো প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি আরও ৫০০ কেজি আম পাঠাতে বলেন। কিন্তু আমি উৎপাদন স্বল্পতার জন্য পাঠাতে পারিনি।
তরুণ এই কৃষি উদ্যোক্তা আরও জানান, আমাদের দেশ থেকে আম্রপালি, হাঁড়িভাঙা, ফজলি, খিরসাপাতিসহ প্রায় ৬/৭ জাতের আম বিদেশে রপ্তানি হয়। আমিও রপ্তানি করি। কিন্তু এই আমগুলো রপ্তানি করতে গিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। আমের রং, স্বাদ, গন্ধ এবং আমের সাইজ নিয়ে। এছাড়াও আম গাছ থেকে সংগ্রহ করার পর অল্প সময়ের মধ্যে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারলে আম নষ্ট হয়ে যায়। এই সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই আমি ব্যানানা আম নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলাম। এই ব্যানানা আকার আকার বেশ বড়। প্রতিটি আমের ওজন ৩৫০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমটা দেখতে খুব সুন্দর। পাকলে এর রং এবং ঘ্রাণ খুবই আকর্ষণীয়। রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় সুবিধা হলো এই আম গাছ থেকে নামানোর পর প্রায় ১৫/২০ দিন পর্যন্ত রাখা যায় নষ্ট হয় না। বৃষ্টির কারণে যেমন আম্রপালি আম গাছেই ফেটে যায়, ব্যানানা ম্যাংগো বৃষ্টির কারণে কখনো ফেটে যায় না। এ বছর যুক্তরাজ্যে ৫০০ কেজি ব্যানানা আম রপ্তানি করে আমি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছি। এই আম রপ্তানির পর থেকেই অনেকেই আমার কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছে। আশা করি সামনে বছর থেকে অনেকেই এই আম উৎপাদন ও রপ্তানিতে আগ্রহী হবে।
ব্যানানা ম্যাংগো নিয়ে কথা হয় নওগাঁ জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. সামছুল ওয়াদুদ এর সঙ্গে। তিনি বলেন, “নওগাঁ জেলা থেকে ৫০০ কেজি ব্যানানা ম্যাংগো বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এটা আমাদের দেশের জন্য বেশ ভালো খবর। নওগাঁয় বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন এই জাতের আম চাষ করছে। কিন্তু পরিমাণে খুব কম তাই এটা আমাদের পরিসংখ্যানে আসে নাই। তবে নওগাঁ জেলার মাটির যে ধরন তা ব্যানানা ম্যাংগো উৎপাদনে সহায়ক। জেলায় ব্যানানা ম্যাংগোসহ বিভিন্ন জাতের আম চাষে আমরা খামারি ও আম চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। জাতে আমের ভালো ফলন হয় এবং আম চাষিরা লাভবান হয়।”
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল ও আম বিশেষজ্ঞ মো. শরফ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ব্যানানা ম্যাংগো থাইল্যান্ডের একটি জাত। এ জাতের আম আমাদের দেশে উৎপাদন শুরু হয়েছে ৫/৬ বছর আগে থেকে। বিদেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে এই জাতের আম বিশেষ অবদান রাখতে পারবে। কারণ হিসেবে তিনি জানান, বিদেশীরা আম পছন্দের ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয়ে গুরুত্ব দেয়। সেগুলো হলো আমাদের আকার, রং, স্বাদ, ঘ্রাণ ইত্যাদি। আমাদের এশিয়ায় অধিকাংশ দেশগুলোর আমের আকার গোল ও মোটা, রং তেমন আকর্ষণীয় নয়, স্বাদে বেশি মিষ্টি, ঘ্রাণ তেমন নয়। কিন্তু ব্যানানা ম্যাংগো আকার লম্বা ও বড়, রং হলুদ, স্বাদ অনেকটাই টক ও মিষ্টি এবং ঘ্রাণ খুবই আকর্ষণীয়। এই কারণগুলোর জন্য ব্যানানা ম্যাংগো বিদেশে খুব চাহিদা রয়েছে।
ব্যানানা ম্যাংগো গাছ রোপণের পরের বছরই ফল আসে। আর একেকটা গাছ প্রায় ৪০/৫০ বছর পর্যন্ত ফল দিয়ে থাকে। পুষ্টিগুণে ভরা এই আমের চামড়া বেশ পাতলা এবং আঁটি খুব চিকন হয়ে থাকে। এই আম পাকে জুলাই মাসের শুরু থেকে যখন অন্যান্য জাতের আম প্রায় শেষ হয়ে যায়। তখন চাষিরা আমের ভালো দাম পায়। এসব দিক উল্লেখ করে ড. মো. শরফ উদ্দিন জানান, এই ব্যানানা ম্যাংগো চাষ করা আম চাষিদের জন্য খুব সহজ ও লাভজনক।