সংসার চালাতে শিক্ষকতা ছেড়ে ফল বিক্রেতা 


মাগুরা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১, ০৭:৪৬ পিএম
সংসার চালাতে শিক্ষকতা ছেড়ে ফল বিক্রেতা 

মাগুরা সদর উপজেলার সৈয়দ রুপাটি গ্রামের আনোয়ারুল ইসলাম। ৪র্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তার বাবা ইছাক মোল্ল্যা মারা যান। এরপর পারিবারিকভাবে সচ্ছলতা না থাকায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় অন্য ভাইয়েরা আলাদা হয়ে যান। সেখান থেকে মাকে নিয়ে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। কখনো টিউশনি কখনো দিনমজুরি করে চলে তার সংসার। ছাত্র ভালো হওয়ায় লেখা পড়া চালিয়ে যান আনোয়ারুল।

স্থানীয় জগদাল সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ২০০২ সালে এসএসসি পাস করেন তিনি। তারপর জগদাল সম্মিলনী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা তিতুমীর কলেজে। সেখানে অর্থাভাবে পড়াশোনা চালাতে না পেরে এক বছর পড়াশোনা বন্ধ ছিল। পরে ভর্তি হন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে।

সেখান থেকে প্রাণিবিদ্যায় অনার্স মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। এরপর ফরিদপুর বায়তুল আমান আদর্শ একাডেমিতে সাড়ে চার বছর শিক্ষকতা করেন। ২০১৬ সালে আনোয়ারুল মাগুরার বনশ্রী রবীন্দ্র সরণি কলেজে যোগ দেন। নন এমপিও কলেজ হওয়াই বিভিন্ন সময় মাগুরা সরকারি কলেজ এর অতিথি শিক্ষক ও টিউশনি করে সংসার চালাতেন তিনি।

দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ। বাড়িতে বাড়িতে টিউশনি বন্ধ করে দেন অবিভাবকরা। অসহায় হয়ে পড়েন শিক্ষক আরোয়ারুল ইসলাম। কোনো উপায় না পেয়ে বেছে নেন ফল বিক্রির পেশা। কিছু টাকা জোগাড় করে শহরের স্টেডিয়াম গেটে বিভিন্ন রকম ফল বিক্রি করে তার সংসার চলে। শহরের বিভিন্নস্থান হতে ফল সংগ্রহ করে বিক্রি করেন তিনি। শহরের স্টেডিয়াম পাড়ায় স্ত্রী ও দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। মা মারা গেছেন বছর খানিক হলো। তবে এই ফল বিক্রিতে খুব বেশি ভালো নেই তিনি।

সবসময় বিক্রি ভালো হয় না। আবার অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। তার কলেজটি এমপিওভুক্ত হলে অথবা একটি এমপিওভুক্ত হওয়া কলেজে চাকরি হলে কষ্টের জীবন শেষ হবে তার বলে মনে করেন তিনি। 

আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, “ছোট বেলা থেকে অনেক কষ্ট করেছি। ৪র্থ শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় আমার বাবা মারা গেছেন। এরপর অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় অন্য ভাইয়েরা আলাদা হয়ে যায়। আমি মাকে নিয়ে থাকি। ছোট বেলা থেকে পড়াশোনায় ভালো থাকায় কখনো দিনমজুর, কখনো টিউশনি করে পড়া চালিয়ে গেছি। ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে থেকে প্রাণিবিদ্যায় অনার্স মাস্টার্স শেষ করেছি। বনশ্রী রবিন্দ্র সরণী কলেজে শিক্ষকতা শুরু করি। কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় টিউশনি ও মাগুরা মহিলা কলেজের গেস্টটিচার হয়ে শিক্ষকতা করেছি। দেশে করোনার সংক্রম শুরু হলো। কলেজ বন্ধ সঙ্গে বন্ধ টিউশনি। বাধ্য হয়ে এই ফল বিক্রির পথ বেছে নেওয়া। কি করবো বলেন? সংসার তো চালাতে হবে। আমি তো আর চুরি করছি না।”

আনোয়ারুলের পাশে টুপি-আতর বিক্রি করা অপর বিক্রেতা খুরশিদ বলেন, “আনোয়ারুল স্যার খুব ভালো মানুষ। কিন্তু উনার মত একজন কলেজের শিক্ষক আমাদের পাশে ফল বিক্রি করছে দেখে খুব খারাপ লাগে।”

বনশ্রী রবিন্দ্র সরণী কলেজে অধ্যক্ষ কালী চরণ দাস বলেন, “আমাদের কলেজটি ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২১৫ জন ছাত্রছাত্রী রয়েছে। শিক্ষক ২০ জন। কলেজটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় আমাদের সকল শিক্ষকরাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ইতিমধ্যে একজন শিক্ষক ফুটপাতে ফল বিক্রি করছেন। অনেকে অন্য পেশার চিন্তা করছেন। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ কলেজের দিকে যদি একটু নজর দেন।”

জেলার শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মো. আলমগীর কবির বলেন, জেলায় ২টি সরকারি কলেজ রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি তিনটি কলেজ জাতীয়করণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জেলায় ১৯টি এমপিওভুক্ত কলেজ আছে। জেলায় ননএমপিওভুক্ত কলেজ রয়েছে ছয়টি। এসকল ননএমপিওভুক্ত কলেজ এমপিওভুক্ত না হওয়ায় সে সকল কলেজের শিক্ষকরা অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন।”

Link copied!