‘আমা’ মানে ‘মা’, চেরাই শব্দের অর্থ ছেলে, ভুব্রুইভুসা মানে মেয়ে। আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ‘ককবরক’ নিয়ে উচ্চারণগত ভিন্নতা থাকলেও ভাষাটি লিখতে ব্যবহার করা হয় বাংলা লিপি। ককবরকের জন্য আদিকাল থেকেই নেই কোনো আলাদা বর্ণমালা। প্রাচীনকাল থেকে এই ভাষায়ই মুখে বুলি ফুটে আসছিলো ত্রিপুরা শিশুদের। তবে প্রাতিষ্ঠানিক কোন চর্চা না থাকায় কালের আবর্তনে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছিলো আদিবাসীদের এই ভাষা।
কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ে আদিবাসী ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর যে ক’টি পরিবার আছে তাদের মধ্যে প্রবীণরাই শুধু জানেন এই ভাষার ব্যবহার। তবে ত্রিপুরাদের এই আদি ভাষা যেন হারিয়ে না যায় এ বছর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই সরকারি ভাবে নেওয়া হয়েছিলো উদ্যোগ। তৈরি করা হয়েছে ককবরক ভাষা শেখানো স্কুল। কোটবাড়ি শালবনের ভেতর পাহাড়ের কোলেই নির্মাণ করা হয়েছে স্কুলটি। আসন্ন পহেলা বৈশাখ থেকেই শুরু হবে ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম। স্বেচ্ছাশ্রমে স্কুলটির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক সরকারি কর্মকর্তা মনিন্দ্র ত্রিপুরা।
ত্রিপুরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তপ্রায় ভাষা ‘ককবরক’ পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সদর দক্ষিণ উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই স্কুল তৈরির কার্যক্রম শুরু করা হয়। গত ২৭ মার্চ বিকেলে স্কুল ভবনের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সরকার বিভাগ-কুমিল্লার উপপরিচালক শওকত ওসমান।
ত্রিপুরা পল্লী ককবরক মাতৃভাষা স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক মনিন্দ্র ত্রিপুরা জানান, ককবরক ভাষায় উচ্চারণগত ভিন্নতা থাকলেও, আলাদা কোনো বর্ণমালা নেই। বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করেই লিখতে হয় এই ভাষা। আদি এই ভাষাটি নতুন প্রজন্মের ত্রিপুরারা যেন ভুলে না যায় তাই এই উদ্যোগ। শুরুতেই প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের এই ভাষা শেখানো হবে। চাইলে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর যে কেউ এই আদি ভাষাটি শিখতে পারবেন।
স্থানীয় সংগঠক সজীব চন্দ্র ত্রিপুরা জানান, কুমিল্লার কোটবাড়ি এলাকায় লালমাই পাহাড়ের কোলে ৩৮টি ত্রিপুরা পরিবারের বসবাস। সালমানপুর, জামমুড়া, হাতি গাড়া এলাকায় ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর আনুমানিক ৫০ জন শিক্ষার্থী প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ে পড়াশুনা করছে। তাদের অনেকেই তাদের এই মাতৃভাষা বলতে জানে না। এই স্কুল নির্মাণের ফলে আদিবাসী এই জনগোষ্ঠী তাদের আদি ইতিহাস ধারণ করবে এবং জানতে পারবে।
সদর দক্ষিণ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাবলু বলেন, স্কুলটি কুমিল্লা এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর জন্য আরেকটি মাইলফলক। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জন্য এমন স্কুল বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষার উন্নয়নের আরো একটি দৃশ্যমান যাত্রা। ত্রিপুরাদের ভাষা যেন হারিয়ে না যায়, তাই এ প্রচেষ্টা। ইতিহাসের মাইল ফলক। ভারতের ত্রিপুরা থেকে ককবরক ভাষার বই সংগ্রহ করে দিবো।
স্থানীয় সরকার বিভাগ, কুমিল্লার উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শওকত ওসমান জানান, উপজাতিদের ভাষা নিয়ে সরকারের নানান ধারাবাহিক কার্যক্রম চালু আছে। কুমিল্লার ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর ককবরক ভাষা নিয়েও সরকার পর্যায়ক্রমে উন্নয়ন কাজ চলবে। নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সংস্কৃতি চর্চা নিয়মিত রাখতে হবে। নিজের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হলে মাতৃভাষার চর্চা করতে হবে।
সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শুভাশিস ঘোষ বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি এই স্কুলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। স্বেচ্ছাশ্রমে আপাতত এই স্কুলের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চলবে। ককবরক ভাষা পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চায় আরও বেগবান হবে। স্কুলের জন্য ভারতের ত্রিপুরার আগরতলা থেকে বই সংগ্রহ। পহেলা বৈশাখে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্কুলের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। বাংলাদেশের আদি ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে একদিন গবেষণার বিষয় হবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।