• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা


রাজীব রাসেল, সিলেট
প্রকাশিত: জুন ১৭, ২০২২, ০৩:২৪ পিএম
বন্যায় সিলেট-সুনামগঞ্জে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চলের পাশাপাশি পানিতে ডুবে আছে নগরের অনেক সড়ক। আর রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় সারা দেশ থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সুনামগঞ্জ।

সিলেট ও সুনামগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি প্রবেশ করায় বাসিন্দারা বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়দের বাড়ি ও বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এ অবস্থায় দুই জেলাতেই বানভাসি মানুষকে উদ্ধারে নেমেছে সেনাবাহিনী। স্থগিত করা হয়েছে এসএসসি পরীক্ষা।

জানা গেছে, সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা সুনামগঞ্জ শহরের। এখানে অফিস-আদালত, বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ পুরো শহর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বন্যায় সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে সারা দেশের সঙ্গে সুনামগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে আন্তজেলা যোগাযোগব্যবস্থাও।

বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন।

অন্যদিকে বন্যায় সিলেট নগরের উপশহর, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, মুরাদপুর, আখালিয়া, তালতলাসহ নদীতীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে গ্রাহকদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরি সতর্কবার্তা দিয়েছে সিলেট বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ।

সিলেটে পর্যাপ্ত নৌকা ও উদ্ধারকর্মী না থাকায় পানিতে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের হাতে পর্যাপ্ত নৌকা ও উদ্ধার সরঞ্জামাদি না থাকায় জেলা প্রশাসক সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছেন।

শুক্রবার (১৭ জুন) সকালে জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারসহ সার্বিক সহযোগিতা চেয়ে ১৭ পদাতিক ডিভিশন সিলেটের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বরাবর চিঠি পাঠান। এরপর উদ্ধারকাজে নামে সেনাবাহিনী।

জানা গেছে, দুই জেলার অন্তত ১৫ উপজেলা বর্তমানে বন্যাকবলিত। সিলেটের অন্তত পাঁচ লক্ষাধিক লোক পানিবন্দি।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, বন্যার পানিতে সুনামগঞ্জ-সিলেট সড়কের ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ-দিঘলী এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সেখান দিয়ে কোনো দূরপাল্লার গাড়ি আপাতত যেতে পারবে না। তবে ছোট যানবাহন, মোটরসাইকেল চলতে পারবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হাইড্রোলজি বিভাগ জানায়, সুনামগঞ্জের ছাতক, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাটের উজানে, মৌলভীবাজারের মনু রেলব্রিজ ও শ্রীমঙ্গলে বৃষ্টিপাত আরও বেড়েছে। জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল, গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলং এবং ভারতের আসাম ও চেরাপুঞ্জি এলাকায় ভারী বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানি আরও বাড়বে।

পাউবো হাইড্রোলজি বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী সত্যেন্দ্র চন্দ বৈদ্য জানান, শুক্রবার (১৭ জুন) সকাল ৯টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে সুনামগঞ্জে। সেখানে ৩৭৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

এছাড়া সুনামগঞ্জের ছাতকে ৩৬৫ মিলিমিটার আর লাউড়ের গড়ে ৩২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।

অপর দিকে সিলেটের জাফলংয়ে ২৬৮ মিলিমিটার আর লালাখালে ১৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সার্বিক পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় সিলেট সার্কিট হাউসে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মুজিবুর রহমান। জেলার বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন ইউপি চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বিভাগীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, “সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখন খুবই ভয়াবহ। মহানগরীর অধিকাংশ এলাকা এবং কমবেশি ১৩টি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভয়াবহ পরিস্থিতি গোয়াইনঘাট, সিলেট সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও জৈন্তাপুর উপজেলায়।”

দুর্যোগ মোকাবেলায় কমিটির সভায় ব্যাপক আলোচনা শেষে বিভিন্ন কৌশল নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি গোয়াইনহাট উপজেলায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়।

সিলেট জেলার ত্রাণ কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, “সিলেটের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নের জন্য চার টন করে এবং অন্যগুলোতে দুই টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। ১৫ জুন পর্যন্ত সিলেট জেলায় মোট ২৯৮ টন এবং ১৬ জুন ১৩৪ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় ৫০০ ব্যাগ/ বস্তা, গোয়াইনঘাট উপজেলায় ১০০০ ব্যাগ/বস্তা, সিলেট সদর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৭০০ ব্যাগ/বস্তা করে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।”

এদিকে সিলেটের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শামস-ই আরেফিন এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গ্রাহকদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে পানিতে কোনো বৈদ্যুতিক তার, খুঁটি বা অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি পড়ে থাকলে কিংবা গাছপালা বৈদ্যুতিক লাইনে পড়লে স্পর্শ না করে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে দ্রুত বিউবো বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ-২-এর দপ্তরে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।

এদিকে আজও সিলেটের নদ-নদীর পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত সুরমা নদী সিলেট শহর, ছাতক, সুনামগঞ্জ ও কানাইঘাট পয়েন্ট এবং সারি নদী বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বেড়েছে।

এ অবস্থায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সিলেটের মানুষ। অনেকেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

Link copied!