পাবনার সুজানগরের খয়রান গ্রামের পেঁয়াজ চাষি রমজান আলী এবারও মুড়িকাটা পেঁয়াজ বিক্রি করে লাভবান হতে পারেননি। সর্বনিম্ন ১৩০০ টাকা মন দরে যদি বিক্রি করেন তবে খরচ হয়তো উঠবে। কিন্তু লাভের মুখ দেখবেন না।
মুড়িকাটা পেঁয়াজ মাঠ থেকে ঘরে তুলতে শুরু করেছে পাবনার বিভিন্ন উপজেলায় প্রান্তিক কৃষকরা। বর্তমানে প্রায় ৮০ শতাংশ চাষি পেঁয়াজ ঘরে তুলেছেন। বাজারে ভরে গেছে এসব নতুন পেঁয়াজে। তবে পেঁয়াজের দাম আশানুরূপ না পাওয়ায় লোকসান গুনতে হবে চাষিদের।
গত কয়েক বছর অধিক দাম পাওয়ায় এ বছরও এ অঞ্চলের পেঁয়াজ চাষিরা বেশি লাভের আশায় অনাবাদী জমি আবাদের উপযুক্ত করে মূলকাটা পেঁয়াজের চাষাবাদ করেছিলেন। উৎপাদন ভাল হলেও বেশিরভাগ চাষিদের লোকসান গুনতে হবে।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আবহাওয়া অনুকূল থাকায় এ মৌসুমে পাবনায় ৯ হাজার ৩০৫ হেক্টরে আবাদ করে প্রায় ১ দশমিক ১১ লাখ মেট্রিক টন মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা আশাতিরিক্ত ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন জেলা কৃষি বিভাগ। তবে সব কৃষকের পেঁয়াজ ঘরে না তোলায় সঠিক উৎপাদনের নির্ণয় করতে পারছেন না কৃষি অফিস। জেলার ৯ উপজেলায় ৮০ শতাংশ জমির পেঁয়াজ তোলা শেষ হয়েছে। চলতি মাসের শেষের দিক সময় পর্যন্ত মূলকাটা পেঁয়াজ তোলা চলবে বলে জানান।
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চরাঞ্চল বা উঁচু জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়। ডিসেম্বরের শেষের দিকে ও জানুয়ারির শুরুতে জমি থেকে পেঁয়াজ তুলে সেগুলো পরিপাটি করে জেলা শহর বা উপজেলাধীন এলাকার বিভিন্ন বাজারে নিয়ে আসেন চাষিরা। চারা পেঁয়াজ ওঠার বাকি আর প্রায় তিনমাস। সেই সময়ের বাজার সামাল দেয় মুড়িকাটা পেঁয়াজ। তাই এই পেঁয়াজ দেশের বাজারে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করে থাকে।
কৃষকরা জানান, অনেকেই মূলকাটা পেঁয়াজ ঘরে তুলে তারপর চারা পেঁয়াজ আবাদ করতে যাচ্ছেন। নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসলেও আশানুরূপ দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। অধিক দামে পেঁয়াজ ক্রয় করে দাম বেশি পাওয়ার আশায় পেঁয়াজ আবাদ করলেও এখন তাদের লোকসান গুনতে হবে বলে ধারণা করছেন। এরপরও জেলায় কোনো পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার নেই। বাধ্য হয়ে তাই মৌসুমের শুরুতেই সব পেঁয়াজ বিক্রি করে দেন তারা।
পাবনা সদরের সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী হাছেন আলী জানান, এখানকার পেঁয়াজের ব্যাপক চাহিদা থাকায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজ কিনতে এখানে আসেন। এখানে পেঁয়াজ বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। এ কারণে কৃষকরা মাঠ থেকে পেঁয়াজ তুলেই স্থানীয় হাট-বাজারে দ্রুত বিক্রি করেন। যার কারণে হাটে অধিক পেঁয়াজ আমদানি হওয়াতে বাজার দর বেপারিদের কারসাজিতে কমিয়ে দেওয়া হয়।
সদরের পুষ্পপাড়া হাটে পেঁয়াজ বিক্রি করতে আসা সাইদুল ইসলাম, রজব আলীসহ অনেক বলেন, গত বছর মুরিকাটা পেঁয়াজের যে দাম ছিল সেটির আশায় আমরা পেঁয়াজ লাগিয়েছিলাম। এখন পেঁয়াজ তুলে হাটে নিয়ে আসলে ঠিকমত দাম বলে না পাইকররা। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট কারসাজি করে বাজার দর কমিয়ে দিয়ে কম দামে পেঁয়াজ কিনে নিয়ে ঢাকার বাজারে অধিক দরে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে। আমরা মাঠে ময়দানে কষ্ট করে লোকসান দিয়ে পেঁয়াজ চাষাবাদ করি আর কিছু সিন্ডিকেটে জন্য আমাদের পথে বসতে হচ্ছে।
ঈশ্বরদী উপজেলার চরগরগরি গ্রামের কৃষক নাসির উদ্দিন বলেন, গত বছর এ সময় এক মণ মূলকাটা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায়। কিন্তু, এ বছর তা পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ১০০ টাকায়। এতে তাদের লোকসান গুনতে হচ্ছে। মূলকাটা পেঁয়াজ ঘরে সংরক্ষণ করা যায় না তাই আশানুরূপ দাম না পেলেও পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
সুজানগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রাফিউল ইসলাম বলেন, এ উপজেলায় গত বছর ১ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে মূলকাটা পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। এবার ১ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ফলন বেশি হয়েছে। দাম একটু কম পেলেও ফলনে পুষিয়ে যাচ্ছে কৃষকদের।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, এ বছর চারা পেঁয়াজ ও মূলকাটা পেঁয়াজ মিলে প্রায় ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে সাড়ে ৭ লাখ টনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এ মৌসুমে পাবনায় ৯ হাজার ৩০৫ হেক্টরে আবাদ করে প্রায় ১ দশমিক ১১ লাখ মেট্রিক টন মূলকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। তবে ফলন যেহেতু ভাল হয়েছে তাই দাম কম হলেও কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়বে না। জেলায় একটি কৃষি পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা যায় কিনা বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে একটি প্রস্তাবনা পাঠানো হবে।