• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
মাগুরছড়া ট্র্যাজেডি

দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ


রাজীব রাসেল, সিলেট
প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২২, ০৮:১৭ এএম
দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও মেলেনি ক্ষতিপূরণ

মঙ্গলবার (১৪ জুন) মাগুরছড়া ট্র্যাজেডির ২৫তম বার্ষিকী। এই ট্র্যাজেডির দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণ। এই দিন এলেই মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জবাসীর মনে পড়ে যায় সেই ভয়াল স্মৃতির কথা। সেদিন মানুষের মনে ভয় ছিল—কখন যে আগুনের লেলিহান শিখা এসে গ্রাস করে ফেলে!

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাত ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে মাগুরছড়া গ্যাসকূপে বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা কমলগঞ্জ। আগুনের লেলিহান শিখায় লাল হয়ে উঠেছিল মৌলভীবাজার জেলার সুনীল আকাশ। ভীতসন্ত্রস্ত লোকজন ঘরের মালামাল রেখে প্রাণভয়ে ছুটছিলেন দিগ্বিদিক। প্রায় ৫০০ ফুট উচ্চতায় লাফিয়ে ওঠা আগুনের লেলিহান শিখায় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। আগুনের শিখায় গ্যাসফিল্ডসংলগ্ন লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, মাগুরছড়া খাসিয়াপুঞ্জি, জীববৈচিত্র্য, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন, ফুলবাড়ি চা-বাগান, সিলেট-ঢাকা ও সিলেট-চট্টগ্রাম রেলপথ এবং কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

অগ্নিকাণ্ডের দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও জনসম্মক্ষে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রকাশ হয়নি, আদায় হয়নি ক্ষতিপূরণও।

পরিবেশবাদীদের তথ্যমতে, ৬৩ প্রজাতির পশু-পাখির বিনাশ সাধন হয় সেই বিস্ফোরণে। সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ ১৬৩ দিন বন্ধ থাকে। মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। মার্কিন অক্সিডেন্টাল ক্ষয়ক্ষতির আংশিক পরিশোধ করলেও বন বিভাগ কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। এখনো ফিরে আসেনি প্রাকৃতিক বনের স্বাভাবিক পরিবেশ। পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না দিয়েই ইউনিকলের কাছে হস্তান্তরের পর সর্বশেষ শেভরনের কাছে বিক্রি করা হয়েছে।

শেভরন ২০০৮ সালে ওই বনে ত্রিমাত্রিক ভূতাত্ত্বিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে। এতেও স্থানীয়ভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ২০১২ সালে শেভরন মৌলভীবাজার ১৪ নম্বর ব্লকের অধীনে নূরজাহান, ফুলবাড়ি এবং জাগছড়া চা-বাগানের সবুজ বেষ্টনী কেটে কূপ খননের পর এসব কূপ থেকে চা-বাগানের ভেতর দিয়ে ড্রেন খনন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে উত্তোলিত গ্যাস কালাছড়ার মাধ্যমে রশীদপুর গ্রিডে স্থানান্তর চলছে। বিভিন্ন সংগঠন মাগুরছড়া দুর্ঘটনায় যথাযথ ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করলেও দীর্ঘ ২৫ বছরেও ক্ষতিগ্রস্তদের দাবিকৃত ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আজ পর্যন্ত জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। মাগুরছড়া দুর্ঘটনার ২৫তম বার্ষিকী পূর্ণ হলেও ক্ষতিপূরণ আদায় নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে আজও ক্ষতিপূরণ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা নীরবে চোখের জল ফেলছেন। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে।

গ্যাসকূপ বিস্ফোরণের পরিত্যক্ত এলাকার উত্তর টিলায় সবুজায়ন করা হয়েছে। মূল কূপটি এখনো পুকুরের মতো আকার ধারণ করে টিকে আছে। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছে। টিলার ওপর সবুজ বনায়নের উদ্যোগ নিলেও মাঝেমধ্যে আগুনের পোড়া ডালপালাবিহীন কালো রঙের গাছগুলো অগ্নিদুর্ঘটনায় সাক্ষী হয়ে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

কমলগঞ্জ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে লাউয়াছড়া ফরেস্ট বিটের অভ্যন্তরে মাগুরছড়া এলাকায় ১৯৮৪-৮৬ ও ১৯৯৪ সালে সাইসলিক সার্ভেতে গ্যাস মজুতের সন্ধান পাওয়া যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উৎপাদন ভাগাভাগির চুক্তিতে ১৯৯৫ সালের ১১ জানুয়ারি মার্কিন বহুজাতিক তেল ও গ্যাস উত্তোলনকারী কোম্পানি অক্সিডেন্টালের সাথে বাংলাদেশ সরকারের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং গ্যাস উত্তোলনের জন্য ৬৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমতি প্রদান করা হয়।

দায়িত্ব গ্রহণের পর অক্সিডেন্টাল কোম্পানি মাগুরছড়ায় গ্যাসফিল্ডের ড্রিলিং কাজের জন্য সাব-লিজ প্রদান করেছিল ডিউটেক নামের জার্মান কোম্পানির কাছে। গ্যাস উত্তোলনে ১৪ নম্বর ব্লকের মাগুরছড়াস্থ মৌলভীবাজার-১ গ্যাসকূপের খননকালে ৮৫০ মিটার গভীরে যেতেই ১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মধ্যরাতে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ।

এ সময় শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ ১৫ কিলোমিটার (৩৩ হাজার কেভি) উচ্চতাপ বৈদ্যুতিক লাইন পুড়ে নষ্ট হয়। কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ উপজেলার ৫০টি চা-বাগানে দীর্ঘ দিনব্যাপী বিদ্যুৎ সংকট দেখা দেয়। ৬৯৫ হেক্টর বনাঞ্চলের বৃক্ষ সম্পদ, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়া ২৪৫ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পুড়ে নষ্ট হয়, যার বাজারমূল্য ছিল ৫০ কোটি ডলার।

গ্যাস বিস্ফোরণের পর অক্সিডেন্টাল তাদের সহোদর ইউনিকলের কাছে দায়িত্ব দিয়ে এ দেশ ত্যাগ করলে দুই বছর পর ফুলবাড়ি চা-বাগান, পার্শ্ববর্তী মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির বাড়িঘর, পান জুম এলাকার ক্ষয়ক্ষতি বাবদ আংশিক টাকা প্রদান করে ইউনিকল। অন্যদিকে দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়কের ধারে সামাজিক বনায়নের রোপিত গাছের জন্য ৩ ব্যক্তিকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হয়।

দীর্ঘ ৬ মাস কমলগঞ্জ-শ্রীমঙ্গল সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে ক্ষতিপূরণ বাবদ বাস মালিক সমিতিকে ২৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়। এছাড়া বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে কিছু ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ ও গ্যাস বাবদ কোনো ক্ষতিপূরণ আদায় হয়নি এবং কোনো সরকারই ক্ষতিপূরণ আদায়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় জনমনে সন্দেহ বিরাজ করছে। দুর্ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহফুজুল ইসলামকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত কমিটি ১৯৯৭ সালের ৩০ জুলাই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করে। তাদের রিপোর্টে অক্সিডেন্টালের দায়ীত্বহীনতাকেই দায়ী করা হয়।

১৯৯৭ সালের ১৪ জুন মাগুরছড়া গ্যাসক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডে বিপুল অঙ্কের ক্ষতি হয়। এ ব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জন্য কোম্পানি দায়ী।

১৯৯৮ সালের ২৫ নভেম্বর ক্ষতিপূরণের কোনো শর্ত না রেখেই দ্বিতীয় দফায় সম্পূরক চুক্তি হয়। এ কারণে ওই চুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন দাখিল করা হয়। শুনানিতে আইনজীবীরা বলেছেন, অক্সিডেন্টাল দেশের প্রচলিত পেট্রোলিয়াম ও পরিবেশ আইন না মেনে কাজ শুরু করে। এছাড়া তারা কোম্পানির সব দায়দায়িত্ব ইউনিকলকে বুঝিয়ে দিয়েছে। তাই ক্ষতিপূরণ আদায়ের লক্ষ্যে ইউনিকলের প্রতি রুল জারির আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু হাইকোর্টের রুলনিশির কোনো সন্তোষজনক জবাব ইউনিকল দেয়নি।

মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির মন্ত্রী জিডিসন প্রধান সুচিয়ান বলেন, “এ ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রাকৃতিক বনের যে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমরা যারা এই বনে বসবাস করছি তারাই শুধু বুঝতে পারছি। প্রাকৃতিক বনের ক্ষতি কখনোই পুষিয়ে ওঠার নয়।”

Link copied!