• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এবার নেকাব ইস্যুতে এলাকাছাড়া আরেক শিক্ষক


সিলেট প্রতিনিধি
প্রকাশিত: এপ্রিল ১২, ২০২২, ০৮:১৮ এএম
এবার নেকাব ইস্যুতে এলাকাছাড়া আরেক শিক্ষক

ঢাকার টিপ-কাণ্ড ও নওগাঁর হিজাব-ইস্যুর রেশ না কাটতেই এবার সিলেটে তোলপাড় চলছে নেকাব-ইস্যু নিয়ে। এই ইস্যুতে ভয়ে গত তিন সপ্তাহ ধরে এলাকাছাড়া সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ভাদেশ্বর নাছির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুনীল চন্দ্র দাস।

এই নেকাব ইস্যুতে গঠিত দুটি কমিটির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে এক কমিটি, আরেকটি কমিটির তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে।

জানা যায়, ভাদেশ্বর নাছির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে গত ১৫ মার্চ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুনীল চন্দ্র দাসের বিরুদ্ধে ক্লাসে এক ছাত্রীকে নেকাব খুলতে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে। বিষয়টি পরে ভুল-বোঝাবুঝি বলে জানান ওই ছাত্রীর বাবা জানান। তবে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে দুটি কমিটি গঠন করে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। একটিতে রাখা হয় স্কুলের গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য ও অপরটিতে রাখা হয় উপজেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তাকে। এর মধ্যে গভর্নিং বডির কমিটি গত রোববার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনার ছুটি শেষে গত ১৫ মার্চ নাছির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস শুরু হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার ক্ষতি পোষাতে ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। ১৫ মার্চ বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক আমিন উদ্দিন অনুপস্থিত থাকায় ক্লাস নিতে যান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুনীল চন্দ্র দাস। ওই ক্লাসেরই এক ছাত্রী অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নেকাব খুলতে বাধ্য করার অভিযোগ তোলে।

সেদিন ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অক্সিজেনের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বুক ভরে শ্বাস নিতে বলেন সুনীল চন্দ্র দাস। তবে নেকাব খুলতে ওই ছাত্রী আপত্তি জানায়। আপত্তির পরও সুনীল তাকে শ্বাস নেওয়ার সুবিধার্থে নেকাব খোলার কথা বললে অবশেষে ওই ছাত্রী নেকাব খোলে।

পরে বিষয়টি বাড়িতে গিয়ে মা-বাবাকে জানায় ওই ছাত্রী। তার মা মোবাইল ফোনে বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতির কাছে এ নিয়ে অভিযোগ করেন। অন্যদিকে ছাত্রীর বাবা আব্দুল হালিম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে মেয়ের সঙ্গে শিক্ষকের এই আচরণের বিচার চান।

ওই ছাত্রীর বাবার ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর এলাকার অনেকে বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে লিখতে থাকেন। কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে বোরকা ও হিজাব নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ তোলা হয় এবং স্থানীয়দের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।

সেই রাতেই ওই ছাত্রীর বাসায় যান অধ্যক্ষ সুনীল চন্দ্র দাস, কয়েকজন শিক্ষক এবং গভর্নিং বডির কয়েকজন সদস্য। তারা পুরো ব্যাপারটি বুঝিয়ে মেয়েটির বাবার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বিষয়টি মিটমাট করে ফেলেন।

এরপর স্কুলছাত্রীর বাবা ফেসবুকে আরেকটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লেখেন, “ফেসবুকে আমার মেয়ে ভাদেশ্বর নাছির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে নিয়ে সম্পূর্ণ মনগড়া ও ভ্রান্ত কিছু লেখালেখি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে, যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। শ্রেণিকক্ষে সব ছাত্র-ছাত্রীর করোনাকালীন মাস্ক ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করা হয়। এখানে আমার মেয়ের হিজাব খোলার বিষয়টি আদৌ সত্য নয়। বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ জানাই।”

এদিকে এর মধ্যে বোরকা ও হিজাবে মুখ ঢাকা আরেকটি মেয়ের ভিডিও বার্তা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েটি নিজেকে ওই ছাত্রীর সহপাঠী দাবি করে ভিডিওতে বলে—ওই ক্লাসে সেদিন অধ্যক্ষ সুনীল তার বান্ধবীকে নেকাব খুলতে বাধ্য করেন।

ওই ভিডিওর পর এলাকায় ক্ষোভের মাত্রা আরও বেড়ে যায়। এ বিষয়ে গত ২০ মার্চ এলাকাবাসীকে নিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণে সভা ডাকেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শামীম আহমদ। সেখানে এলাকাবাসী সুনীল চন্দ্রের শাস্তি দাবি করেন।

পরে এ বিষয়ে দুটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির টিম হয় ৫ সদস্যের এবং উপজেলা প্রশাসনের টিম হয় ৩ সদস্যের। এর মধ্যে গভর্নিং বডির তদন্ত কমিটি গত রোববার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

এই কমিটির প্রধান স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শামীম আহমদ প্রতিবেদনে কী আছে, সেটি এখনই জানাতে চাইছেন না। তিনি বলেন, “তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে পরবর্তীতে বিস্তারিত জানাবেন।”

এ ঘটনা তদন্তে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. গোলাম কবিরের গঠন করা কমিটির প্রধান উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বলেন, “আমরা তদন্ত কাজ শুরু করেছি। তদন্ত চলমান আছে। এখন কিছু বলার সুযোগ নেই। তদন্ত শেষ হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।”

এদিকে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক তাহের উদ্দিন বলেন, “আমি ঘটনার দিন স্কুলে ছিলাম। পরে অধ্যক্ষের সঙ্গে ওই ছাত্রীর বাসায়ও গিয়েছি। যেভাবে ছড়ানো হয়েছে সে রকম ঘটনা ঘটেনি।”

আর সহকারী শিক্ষিকা নুরুন্নাহার ঝুমুর বলেন, “আমি ঘটনা শোনার পর ওই ক্লাসের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। তারা জানিয়েছে, স্যার খোলা বাতাসে শ্বাস নেওয়ার জন্য মাস্ক খুলতে বলেছেন। একজন না খোলায় স্যার তাকে কয়েকবার অনুরোধ করেছেন। স্যার বারবার বলার পর রাগ করে সে নেকাব খুলেছে। এরপর স্যারকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি শুরু হয়েছে।”

তিনি বলেন, “স্যার প্রায় ২৭ বছর ধরে এখানে আছেন। কখনো কোনো কথা ওঠেনি। তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। বরং সবাই যাতে নামাজ পড়ে সে জন্য স্যার এই প্রতিষ্ঠানে নোটিশ জারি করেছেন।”

এ ব্যাপারে অভিযুক্ত ভাদেশ্বর নাছির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সুনীল চন্দ্র দাস বলেন, “সেদিন শিক্ষার্থীদের অনেকের মুখে মাস্ক পরা ছিল। আর কয়েকজন ছাত্রীর মুখে নেকাব ছিল। আমি তাদের মাস্ক ও নেকাব খুলে শ্বাস নিতে বলি। হিজাব নিয়ে কোনো কথাই বলিনি।”

তিনি আরও বলেন, “অভিযোগকারী ছাত্রীর বাবা তার অভিযোগ তুলে নেন। এরপর একটি গোষ্ঠী ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীকে উসকে দেয়। তারা এলাকায় বিক্ষোভ করে। ফেসবুকে নানান বাজে কথা লিখতে থাকে। বেশির ভাগ জামায়াতের লোক এতে জড়িত। আমার প্রতিষ্ঠানের কিছু শিক্ষকেরও ইন্ধন রয়েছে। পদ-পদবির জন্য তারা এমনটি করছেন।”

সুনীল চন্দ্র দাস বলেন, “ভয়ে গত ২০ মার্চ থেকে আমি এলাকাছাড়া। পরিবারের নিরাপত্তা ও মানসম্মানের কথা ভেবে আমি ছুটি নিয়ে চলে এসেছি।”

এ বিষয়ে গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুনুর রশীদ চৌধুরী জানিয়েছেন, এলাকার পরিবেশ এখন শান্ত। আর কোনো ঝামেলা নেই।
 

স্বদেশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!