• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০২৪, ৬ কার্তিক ১৪৩১, ১৮ রবিউস সানি ১৪৪৬
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর প্রশ্ন

‘এই অবস্থায় কোথায় যাবো, কী করব’


কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশিত: মে ১৭, ২০২২, ০৫:৪৮ পিএম
‘এই অবস্থায় কোথায় যাবো, কী করব’

প্রতিটি নবজাতক জন্মের পর পৃথিবীর আলো দেখেন। আদর মাখা পরশ নিয়ে ধীরে ধীরে সে বড় হয়। আলোকিত করে সমাজকে। ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য দেখে নিজেকে সাজায় আপন গতিতে। একটা সুন্দর জীবন গড়তে অবিচল চেষ্টা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচতে চায় সবাই। কিন্তু জন্মের পর যদি কোনো শিশু দৃষ্টিহীন হয়, তখন সে সমাজের চোখে বোঝা হয়ে যায়। তবুও, নানা প্রতিকূলতা, অবহেলা ও অবজ্ঞার মধ্য দিয়ে তাকে বাঁচতে হয়। তাহলে সে জীবন কি আর অর্থ বহন করে?

এমনি এক দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিউলি বেগম (৩৩)। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ঘোগাদহে তার বাড়ি।

জন্মের পর বাবাকে পায়নি শিউলি বেগম। অনেক কষ্টে ভিক্ষাবৃত্তি করে কোনরকম তাকে বড় করেন তার মা। এভাবে বড় হয় শিউলি। বিয়েও হয়। কিন্তু দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হওয়ায় স্বামীর সংসারেও থাকতে পারেননি তিনি।

শিউলি বেগম ঘোগাদহ ইউনিয়নের সোবনদহ গ্রামে নানা মো. ওসমান আলীর বাড়িতে থাকেন। এক ছেলে এক মেয়ে ও বৃদ্ধা মাকে নিয়ে তার অভাবের সংসার। দৃষ্টিহীন শিউলির আয় রোজকার তেমন নেই। সরকারের দেওয়া ভাতার টাকা যা পান তা দিয়ে তার সংসার চলে। এ অবস্থায় পরিবারের তিন সদস্যকে নিয়ে চরম কষ্টে দিন পাড় করছেন তিনি । এই অবস্থাতেও এক ছেলে জুয়েল (১০), মেয়ে জুঁই (৬) ও বৃদ্ধা মা ফিরোজাকে নিয়ে সংসার কোনো রকম চালিয়ে নিচ্ছেন।

ভূমিহীন এই পরিবারটির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৩২-৩৩ বছর আগে দিনমজুর নানা ওসমানের বাড়ি সোবনদহ গ্রামে জন্ম হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিউলির। তেমনই একজন বিধবা মায়ের দৃষ্টি প্রতিবন্ধি মেয়ে শিউলি বেগম। মা অন্যের বাড়িতে দিনমজুরির কাজ করে মেয়েকে লালন পালন করেছেন। পরে অবশ্য মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে পাশ্ববর্তী একটি গ্রামে বিয়েও দিয়েছিলেন মা।

সুখে শান্তিতে চলছিল শিউলির সংসার। দীর্ঘ ১০ বছর সংসার জীবনে এক ছেলে এক মেয়ের মা হন শিউলি। পরে স্বামী শাহআলম ছেড়ে দিলে শিউলির আর ঠাই হয়নি স্বামীর বাড়িতে। উপায়ন্তু না পেয়ে অবশেষে চলে আসেন বৃদ্ধা মায়ের বাড়িতে। ছেলে-মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের সহযোগিতায় শুরু করেন ভিক্ষাবৃত্তি। ভিক্ষাবৃত্তি করেই কোনরকম চলছিল তাদের অভাব অনটনের সংসার,জমিয়েছেন সামান্য কিছু টাকাও।

তবে গত ৩-৪ বছর আগে সরলমনা শিউলির জীবনে নেমে আসে আরেক ছলনাময় অধ্যায়। দীর্ঘ আশা ও স্বপ্ন নিয়ে আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন তিনি। বিয়ে করেন কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের বাবু নামের একজনকে। শুরু হয় নতুন সংসার।

স্বপ্ন ছিল দ্বিতীয় বিয়ে করে সুখে শান্তিতে বাকি জীবনবটা কাটিয়ে দিবেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর আশা ভেঙে চুরমার করেন দ্বিতীয় স্বামী বাবু। বিয়ের কিছুদিন পর শিউলির কষ্টার্জিত জমানো টাকা নিয়ে উধাও হয় সেই স্বামী। পরে তারা জানতে পারে বিয়েটি ছিল পরিকল্পিত।

এতে অন্ধ শিউলির জীবনে আবার শুরু হয় হতাশা। সরকারিভাবে সে প্রতিবন্ধী ভাতা পেলেও তার পরিবারের চার সদস্যের জন্য এটা যথেষ্ট নয়।

দৃষ্টিহীন শিউলির সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, “আমার জন্ম হয় নানার বাড়িতে। জন্মের পর আমি আমার বাবাকেও দেখি নাই, সূর্যের আলো যে কেমন তাও জানি না। নিজের কোনো জমিজমা নাই। থাকি নানার বাড়িতে। মা আমাকে বড় করে বিয়ে দেয়। দুই ছেলে মেয়ে হওয়ার পর স্বামী আমাকে ডিভোর্স দেয়। মায়ের বাড়িতে এসে দুই সন্তান ও বৃদ্ধা মাকে বাঁচাতে ভিক্ষা করা শুরু করি।”

শিউলি বলেন, “৩-৪ বছর আগে বাবু নামের এক ছেলে আমাকে ভুয়া বিয়ে করে আমার জমানো কিছু টাকা ছিল নিয়ে পালিয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমরা মামলা করলেও হেরে গেছি। আমার ছেলে মেয়ে যে দোকানে ৫টা টাকা খাবে চাইলেও দিতে পারছি না। তিন বেলা তাদের খাওয়াতে পারছি না। কী অপরাধ করেছি যে আল্লাহ আমাকে এতো কষ্ট দিচ্ছে? আগে আমার মায়ের সহযোগিতায় ভিক্ষা করতাম। এখন মা চলতে পারে না তাই আর ভিক্ষা করতে পারছি না। কোনো কোনো দিন না খেয়েও থাকতে হচ্ছে আমাদের।

তিনি আরও বলেন, “কিছুদিন আগে স্থানীয় এক এনজিও আমাকে সহায়তা করেছে। আমি খুবই অসুস্থ হয়েছি কিছুদিন আগে তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে জীবন বাঁচাইছে। তারা যদি সহযোগিতায় না করত আমার মরা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। এই অবস্থায় কোথায় যাবো কী করব ভেবে কোনো কুল কিনারা পাচ্ছি না।”

স্থানীয় বাসিন্দা আয়শা বলেন, “শিউলির খুবই কষ্ট, কারণ সে অন্ধ। ওর মায়ের অনেক বয়স হয়েছে। আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করত, এখন তাও করতে পারে না। বয়স হয়েছে। এ কারণেই কেউ আর কাজ করতেও ডাকে না। আমাদের গ্রামে শিউলিরা সবচাইতে গরিব। কেউ যদি এদেরকে সহযোগিতা করত তাহলে কষ্ট কিছুটা কমতো তাদের।”

এ বিষয়ে ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মালেক সরকার বলেন, “তারা অত্যন্ত গরিব পরিবার। পরিবারে আয় করার মতো কেউ নেই। আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিউলিকে ভালোভাবেই চিনি। নিজেদের কোনো জায়গা জমিও নাই তাদের। আমি এর আগেও ১৩ বছরের বেশি সময় চেয়ারম্যান ছিলাম। ওই পরিবারটিকে সবসময় সহযোগিতা করেছি।  এবারও চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি সরকারিভাবে কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়াও তাদেরকে স্পেশালভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করব।”

Link copied!