পানিতে ভাসছে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া উপহার। বিলের মধ্যে করা ঘরে দুইমাস ধরে পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৮টি পরিবার। শুধু এটিই নয় নিচু জায়গায় ঘর তৈরি করায় নোয়াগ্রাম এবং কুলশুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের একই দশা।
নড়াইলের কালিয়া উপজেলার চাচুড়ি ইউনিয়নের আটঘরিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পেয়েছেন পাশের কালডাঙ্গা, বনগ্রাম, সরকেলডাঙ্গা, আরাজী বাসগ্রাম, আটঘরিয়া, কলিমন ও আটলিয়া গ্রামের বাস্তুহারা মানুষ। স্থায়ীভাবে পাকা ঘর এবং জমি পেয়ে সকলেই খুব খুশি হয়ে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন, কিন্তু মাস না যেতেই সেই খুশির ঘরই এখন তাদের গলার কাঁটা না পারছেন ঘর ছেড়ে যেতে আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবারও উপায় নেই।
যশোরের নওয়াপাড়ায় একটি মিলে কাজ করতেন দিনমজুর মোস্তফা শেখ। স্ত্রী, ছেলে, ছেলে বৌ সব মিলিয়ে ভাড়ায় থেকে তাদের দিনকাল চলছিল। এলাকায় সরকার ঘর দিচ্ছে এই খবরে সব ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে ফিরে নতুন ঘরে ওঠেন। এর ওর জমিতে খেটে শেষ জীবনে এলাকার মানুষের সঙ্গে কাটাবেন এই ছিল স্বপ্ন। তার স্বপ্ন নষ্ট করে দিল বিলের পানি। এখন নিরাপদে থাকা তো দূরের কথা, গত দুইমাস ধরে হাঁটু পানিতে চলছে তার সংসার।
শুধু মোস্তফাই নয় ইজ্জত আলী, আসমাউল, শিল্পী, হেলাল উদ্দিনের মতো আটঘরিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৮টি পরিবারের ৭০জন মানুষ দুইমাস ধরে কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে।
পানির মধ্যে পুরো আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো ভাসছে প্রায় তিন ফুট পানিতে। পাশের একটু উচু জায়গায় চুলা তৈরি করে সেখানে পালাক্রমে রান্না চলছে, বৃষ্টিতে তাও বন্ধ হয়ে যায়। ভেতরে ঢুকতে গেলে কোথাও হাঁটুপানি আবার কোথাও আরও বেশি। ঘরের ভেতরে দিনরাত পানি সেচে চলেছেন নারীরা। ঘরের মধ্যে পাকা বাথরুমে হাটুপানি তাই রাতের বেলা এখানে-সেখানে প্রাকৃতিক কাজ সারছে নারীরা। একে পানিতে একাকার, এরপর অভিযোগ রয়েছে নিম্নানের নির্মাণের। কয়েকটি ঘরের মেঝে দেবে গিয়ে ফেটে চৌচির। কাদা দিয়ে তা লেপে রাখার চেষ্টা চলছে। কারো ঘরে জ্বালানি আর জামাকাপড় একসঙ্গে রাখা রয়েছে, পানিতে ভাসছে খাবারের হাড়ি। পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে খেয়ে আবার সেই পানিতেই হাত ধুয়ে নিচ্ছেন।
এটা দিনের চিত্র, রাতের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বিদ্যুতের ব্যবস্থা এখনও হয়নি, তাই সন্ধ্যা হলেই ঘরের মধ্যে পানির ওপর পাতা খাটে কোনো রকমে সাপের ভয়ে জবুথুবু হয়ে বসে থাকেন নারীরা। ছোট শিশুদের পানিতে ডুবে যাবার ভয়ে মায়েরা জেগেই রাত কাটাচ্ছেন। বিলের পানিতে থাকা সাপ ঢুকে পড়ে আশ্রয়ণ প্রকল্পের পানিতে,কয়েকজনকে এরমধ্যে কামড়িয়েছে। বিলের মধ্য থেকে অনায়াসে নৌকা নিয়ে পুরো এলাকায় যাচ্ছেন লোকেরা। বন্যার চেয়েও এক ভয়াবহ চিত্র এই আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা মোস্তফা শেখ বলেন, “ঘর পেয়ে খুব ভালো লাগছিল, জীবনে এমন ঘর করতি পারবো না। এহন যে ঘর দেখতিছি তার চেয়ে পলিথিনির কুড়ে দিলিও ভালো থাকতাম। মেঝে কোনো রকমে সিমেন্ট লেপে গেছে,তা উঠে গর্ত তৈরি হচ্ছে, পিলারে খেমছি (চিমটি) দিলি গুড়ো গুড়ো হয়ে পড়তিছে। পাকা বাড়ির সাধ মিটে গেছে।”
পুস্পরানী বলেন, “ছোট ছেলে নিয়ে থাকি, একে সাপের ভয় এরপর পানিতে পড়ে যাবার ভয়। পানির মধ্যে ছেলেরে খাটে ঘুমাতে দিয়ে জেগে থাকি। আমাগের এই কষ্টডা একটু ভালো করে লেখেন।”
বন্যার চেয়েও ভয়াবহ পরিবেশ হলেও দেখার কেউ নেই। সরকারি ঘর পেয়েও এর ওর বাড়িতে রাত কাটাতে হচ্ছে অসহায় এসব মানুষের। আবার সেই ছিন্নমূল জীবন শুরু হতভাগ্য মানুষগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নড়াইলে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের মোট ৪৭৭টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। কালিয়া উপজেলায় দুইধাপে আড়াইশ ঘর প্রদান করেছে সরকার। চাচুড়ী বিলের মধ্যে অবস্থিত আটঘরিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পে বছরে ৬ মাসই পানির মধ্যে থাকে। কুলসুর, নোয়গ্রামসহ নবগঙ্গা নদীর চরে আরও অনেক আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের একই দশা।
কালিয়া উপজেলায় সদ্য যোগদানকারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আরিফুল ইসলাম এই বিষয়টি নিয়ে নেগেটিভ নিউজ না করার জন্য অনুরোধ করে বলেন, “এটা জোয়ারের পানি এসেছে, আমরা রিং বাঁধ তৈরি করে সমস্যা সমাধান করে ফেলব।”