ঢাকায় আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান হত্যাকাণ্ডের পর ‘মূল শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশকে (৩৬) দুঃসাহসিক এক অভিযানে গ্রেপ্তার করে বগুড়া পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই রোববার (২৭ মার্চ) সকাল সোয়া ৭টার দিকে শহরের চারমাথা বাস টার্মিনালের পাশে খাজা আবাসিক হোটেলর দ্বিতীয় তালার ১০১ নম্বর কক্ষ থেকে মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়। মাসুম ওই হোটেলে ‘মামুন’ পরিচয়ে রুম ভাড়া নিয়েছিলেন।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বগুড়া সদর পুলিশ ফাঁড়ির দুই কর্মকর্তা পরিদর্শক তাজমিলুর ও উপপরিদর্শক (এসআই) খোরশেদ মোটরসাইকেলে করে সেখানে পৌঁছে মাসুমের অবস্থানের তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এসআই খোরশেদ জানান, প্রাথমিকভাবে মাসুম জানিয়েছেন, এক বাল্যবন্ধুর সহযোগিতায় বগুড়ার ওই আবাসিক হোটেলে ওঠেন তিনি। তবে তার ওই বন্ধু কিলিং মিশনের সঙ্গে জড়িত নন। পুলিশের অভিযানের ঠিক ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে সেই বাল্যবন্ধু হোটেল থেকে চলে যান।
যেভাবে গ্রেপ্তার অভিযান
মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) থেকে বগুড়া পুলিশকে প্রথমে জানানো হয়, শহরের সাতমাথায় ‘খাজা’ নামের কোথাও শুটার মাসুম অবস্থান করছেন। সেই তথ্য জানার পরেই খাজা নামের সেই প্রতিষ্ঠানটির সন্ধান শুরু করে বগুড়া পুলিশ। একপর্যায়ে চারমাথা এলাকার খাজা আবসিক নামের হোটেলটির সন্ধান পাওয়া যায়। এরপরেই দ্রুত সময়ে ইন্সপেক্টর তাজমিলুর ও এসআই খোরশেদ মোটরসাইকেল করে সেখানে পৌঁছান। অভিযুক্তকে কোনো কিছু বুঝে ওঠার সময় না দিয়ে হোটেল ম্যানেজারকে ডিএমপির ডিবি পুলিশের পাঠানো মাসুমের ছবি দেখানো হয়। অনেকটা নিশ্চিত হওয়ার পরেই এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা আবাসিক হোটেলটির দ্বিতীয় তলার ১০১ নম্বর কক্ষে প্রবেশ করেন। এরপর এসআই খোরশেদ দ্রুত সময়ে তার হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন। এর মধ্যে ইন্সপেক্টর তাজমিলুর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাসুমকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করে অতিরিক্ত পুলিশ পাঠাতে বলেন। এই সবকিছু হয়েছে সকাল সোয়া ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে, অর্থাৎ মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে।
মাসুম জানান তার কাছে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র নেই। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র তিনি ঢাকায় লুকিয়ে রেখে এসেছেন। পাশাপাশি তার ব্যবহত মুঠোফোনও তিনি হাতিরঝিলে নষ্ট করে রেখে এসেছেন। এরপরও পুলিশ ১০১ নম্বর রুমের কক্ষটিতে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তল্লাশি চালিয়ে তার কথার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তারপরেই সকাল ৮টার দিকে মাসুমকে পুলিশ সদর থানায় নিয়ে আসে।
যেভাবে হোটেলে কক্ষ ভাড়া নেন মাসুম
খাজা হাইওয়ে মোটেল নামের আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার আইয়ুব আলী জানান, মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন রাজন নামের এক যুবক মাঝেমধ্যেই হোটেলে থাকতেন। সেই সুবাদে রাজন হোটেলে পরিচিত। শনিবার (২৬ মার্চ) রাজন হোটেলের ১১১ নম্বর কক্ষ ভাড়া নিয়ে অবস্থান করেন। রাজন হোটেল কর্তৃপক্ষকে জানান ঢাকা থেকে তার এক বন্ধু আসবেন। তার জন্য একটি কক্ষ রাখতে বলেন। রাজনের কথায় হোটেল কর্তৃপক্ষ ৪০০ টাকা ভাড়ায় ১০১ নম্বর কক্ষটি ফাঁকা রেখে দেন। রাত সাড়ে ১২টায় রাজনের বন্ধু পরিচয়ে হোটেলে আসা যুবককে ১০১ নম্বর কক্ষের চাবি দেওয়া হয়। নাম-ঠিকানা পরে এন্ট্রি করবেন বলে তিনি রুমে চলে যান। রাজন রোববার সকাল ৭টার দিকে কক্ষ ছেড়ে দিয়ে রাজশাহী চলে যান বলে জানিয়েছে হোটেল কর্তৃপক্ষ।
মাসুম ওরফে আকাশকে গ্রেপ্তার অভিযানে নেতৃত্বে থাকা পুলিশ পরিদর্শক তাজমিলুর রহমান বলেন, হাতকড়া লাগানোর পর তিনি নিজে থেকেই জোড়া খুনের বর্ণনা দেন। মাসুম এর আগেও ঢাকাতে একজনকে গুলি করে হত্যা করেন বলে পুলিশকে জানান। এছাড়া তার নামে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ৫টি চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। জোড়া খুনের পর ওই রাতেই ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ভেঙে সিমকার্ডসহ হাতিরঝিলে ফেলে দেন তিনি। পরদিন তিনটি নতুন মোবাইল সেট কেনেন এবং ৩টি সিম কার্ড সংগ্রহ করেন। যার একটি নম্বর মাসুম ব্যবহার শুরু করেন। শুক্রবার ঢাকাতেই পালিয়ে থাকার পর শনিবার সন্ধ্যায় একটি বাস যোগে বগুড়ার উদ্দেশে রওনা দেন। বগুড়া পৌঁছার আগেই রাত সাড়ে ১০টার দিকে তিনি মোবাইল ফোনে তার মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। এরপর মাসুম মোবাইল ফোনে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
বগুড়ার সদর পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) খোরশেদ আলম জানান, গ্রেপ্তারের পরেই মাসুম আওয়ামী লীগ নেতাকে গুলি করে হত্যার কথা স্বীকার করেন। আর কলেজছাত্রী সামিয়ার নিহতের খবর তিনি টিভিতে দেখার পরে জানতে পারেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বগুড়া হয়ে জয়পুরহাট দিয়ে প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যাওয়া।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, “মাসুম গ্রেপ্তারের সময় খুব স্বাভাবিক ছিল। সাবলীলভাবে তার অপরাধ স্বীকার করেছেন। এ ছাড়া তিনি অবাক হয়েছিলেন কীভাবে আমরা তার সন্ধান পেলাম। তার ধারণা ছিল তিনি খুব নিরাপদে পালাতে সক্ষম হবেন।”
বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সেলিম রেজা বলেন, “ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমাদের কাছে শনাক্ত করার জন্য শুধু খাজা নামটি ছিল। তবে দ্রুত সময়ে তার অবস্থান আমরা অ্যানালগভাবে শনাক্ত করি ও গ্রেপ্তারে সক্ষম হই।”
বৃহস্পতিবার (২৪ মার্চ) রাত ১০টার দিকে রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলিতে রিকশা আরোহী কলেজছাত্রী সামিয়া নিহত হন।