শয্যা থাকলেও চিকিৎসা নেই  


শেরপুর প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জুলাই ৩১, ২০২১, ০৩:৪৮ পিএম
শয্যা থাকলেও চিকিৎসা নেই  

প্রায় ১৬ লাখ মানুষের বসবাস শেরপুরে। আর জেলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে কর্মরত চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১৯ জন। চিকিৎসক ও জনবলসংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। শুধু চিকিৎসক সঙ্কট নয়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবসহ রয়েছে নানা সমস্যা। ৫০ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও রয়েছে একই সংকট। এদিকে জেলায় করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুও সংখ্যা বেড়েই চলছে। তবে হাসপাতালে শূন্যপদগুলো পূরণ করতে ও সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলার সিভিল সার্জন।

তথ্য অনুযায়ী, এ জেলার মানুষের সেবা দিতে সদরে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও নিশ্চিত হয়নি ১০০ শয্যার মানও। হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা বাড়লেও বর্তমানে কর্মরত চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১৯ জন। অথচ ১০০ শয্যার জন্যই চিকিৎসকের অনুমোদিত পদ ছিল ৩৬। জরুরি বিভাগের তিন চিকিৎসকের সবগুলো পদই খালি। চারজন মেডিকেল অফিসারের দুটি পদই শূন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১০টি পদের সবগুলোই শূন্য। নার্সের ৮৯টি পদের মধ্যে শূন্য আছে ১৭টি। এছাড়াও নেই রেডিওলজিস্ট ও প্যাথলজিস্ট। আয়া, ওয়ার্ডবয় এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংকট দীর্ঘদিনের। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে ২ চিকিৎসক, ৮ নার্সসহ ১৭ জন কর্মী আইসোলেশনে রয়েছেন। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, গাইনি, ইএনটিসহ গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসক না থাকায় রোগী আসলেই রেফার করা হয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

এদিকে ৩১ জুলাই শনিবার জেলা সদর হাসপাতালের কোভিড ওয়ার্ডে ৬০ জন ও আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৬২ জনসহ মোট ১২২ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। জেলায় মোট আক্রান্ত ৩৪৬১ জন এবং সুস্থ হয়েছেন ২৫২৩ বর্তমানে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮৬৭জন। আর মারা গেছেন ৭১ জন।

জেলা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, অক্সিজেনের সংকট না থাকলেও নেই পর্যাপ্ত আইসিইউ। এতে মুমূর্ষু রোগীদের নিবিড় পরিচর্যায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। হাসপাতালটিতে তিনটি ভেন্টিলেটর এবং চারটি হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা থাকলেও জনবলের অভাবে সেগুলোও ঠিকমতো ব্যবহার করা হচ্ছে না।

এছাড়াও ডাক্তার দেখাতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হয় টিকিট। কোনকোন চিকিৎসক পর্যন্ত যেতে প্রতি রোগীর সময় লাগে দুই থেকে তিন ঘণ্টা। রোগীর ভিড়ে চিকিৎসা দিতে হিমশিম পোহান চিকিৎসক। আবার ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভদের হয়রানিও চরমে।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, শ্রীবরদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১৪ জন, ঝিনাইগাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৭ জন থাকার কথা থাকলেও আছে ১২ জন, নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৮ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও রয়েছে ১১জন, নালিতাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২২জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও দায়িত্ব পালন করছেন ১৫ জন চিকিৎসক। এছাড়াও প্রতিটি হাসপাতালেই দায়িত্বরত অন্যান্য পদেও রয়েছে জনবলের তীব্র সঙ্কট। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতেও এখন সেবা সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।

জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু সামিয়ার মা সুলতানা বেগম বলেন, “বাপুরে এই ছয় তলা পর্যন্ত সিঁড়ি বাইয়ে উডতে জান বের হয়ে যায়। লিফট টা বন্ধ করে রাখছে। এই ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও ফ্যান চলে না। আমি এমনিতেই পেশারের রোগী। গরমে নোকাল হয়ে গেলাম।”

নালিতাবাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে আসা আব্বাস উদ্দিন বলেন, “আমি গতকালও আইছিলাম ডাক্তার ছিল না। আজ অনেকক্ষণ বইসে থাইক্কা ডাক্তারের সাক্ষাত পাইছি। বাবারে গরীব রোগীরা নিয়মিত সেবা পায় না সরকারি হাসপাতাল থাইক্কা।”

জেলার নাগরিক সংগঠন জন–উদ্যোগের আহবায়ক আবুল কালাম আযাদ বলেন, “চিকিৎসক, নার্স ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সদর হাসপাতাল। অনেকটাই জোড়াতালি দিয়ে চলছে চিকিৎসাসেবা। এতে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন রোগী।

সেচ্চাসেবী সংগঠন শেরপুর অক্সিজেন ব্যাংকের সমন্বনয়ক এসএম জোবায়ের দিপ বলেন, “এখন জেলার হাসপাতালগুলো যেন রেফার্ড হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। রোগীর চাপ বাড়লেই মমেকে পাঠিয়ে দেয়। এছাড়াও এখানকার রোগীর সাথে নার্সদের দু:ব্যবহারেরও অভিযোগ অনেক।”

দ্রুত জনবলসংকট ও অন্যান্য সমস্যা নিরসনে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও মন্ত্রণালয়সহ সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

শেরপুরের বিএমএ সভাপতি ডা. এমএ বারেক তোতা বলেন, “চিকিৎসা সেবার মান বাড়াতে অনতিবিলম্বে চিকিৎসক সঙ্কট দূর করতে হবে। আমাদের সেবায় কোনো ঘাটতি নেই। আমরা যতজন ডাক্তার থাকা উচিত, রয়েছি এর অর্ধেক। দ্রুতই এই ঘাটতি আমরা কাটিয়ে উঠব।”

শেরপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. খাইরুল কবির সুমন বলেন, “প্রতিদিন আউটডোরে ৭০০ থেকে ৮০০ রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। আর ইনডোরে গড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ২৫০ শয্যার হাসপাতালে বর্তমানে ১০০টি বেড আলাদা করোনা ইউনিটের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১১০-১২০ জন করোনা রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ১০০ শয্যার বরাদ্দ দিয়ে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল চালাতে গিয়ে ভর্তি থাকা রোগীদের ওষুধ ও খাবারের জোগান দিতেও সমস্যা হচ্ছে। পাশাপাশি চিকিৎসাসেবার মান হারাচ্ছে।”

শেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. এ কে এম আনোয়ারুর রউফ জনবল সঙ্কটসহ নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেন, “আমাদের জনবলসংকট রয়েছে এ কথা সত্য। তার পরও করোনা ও সাধারণ রোগীর সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু চিকিৎসক, নার্স ও জনবলসংকটে সবসময় তা হয়ে উঠছে না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে এরইমধ্যে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। দ্রুত চিকিৎসক সঙ্কটের এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।”

Link copied!