রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পরিবার পরিজনের জন্যে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগের মধ্যেও পাবনার ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করছেন দুই দেশের নাগরিকরা। তারা একে অপরে কাঁধে কাঁধ রেখে কর্মযজ্ঞ সম্পন্নে নিরলসভাবে কাজ করছেন।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছে ঠিক তখন বাংলাদেশে তারা একে অপরে ভাতৃত্বের বন্ধনে কাজ করায় এদেশীয় নাগরিকদের মধ্যে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন।
রূপপুরের রুশ পল্লী খ্যাত মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রকল্পে পারস্পরিক কোনো প্রভাব না পড়লেও তাদের চোখে মুখে রয়েছে দুশ্চিন্তার ছাপ। হাসি খুশি মনে তারা ইচ্ছে মতো পণ্য ক্রয় করলেও গত ৫/৬ দিন ধরে খাদ্য সামগ্রী ছাড়া কোনো পণ্য কিনছেন না।
যুদ্ধ ঘিরে রূপপুর গ্রিন সিটি পল্লী ও মার্কেটগুলোতে রাশিয়ান, ইউক্রেনীয়, বেলারুশ নাগরিকদের মুখোমুখি হলে তারা গণমাধ্যমে জানান, যুদ্ধ মানেই ক্ষতি। আর এ ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের মতো অবস্থা দাঁড়ায়। বাংলাদেশে বসে থেকে টিভির পর্দায় যুদ্ধ সংঘাত দেখা আর পরিবার পরিজনের জন্য দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কী করার আছে। যুদ্ধ থামানো, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সম্মিলিত ভাবে নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্রগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা যুদ্ধ চাই না, আমরা শান্তি চাই। আমরা দ্রুত সমাধানের পথ দেখতে চাই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী মিলে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রাশিয়ান ও ইউক্রেন নাগরিক কর্মরত আছেন। এর মধ্যে রাশিয়ান নাগরিক রয়েছেন ৩২০০’ থেকে ৩৫০০। ইউক্রেনীয় নাগরিক রয়েছেন ২ হাজার থেকে ২২০০। বেলারুশ নাগরিক রয়েছেন ৬০০ থেকে ৬১০ জন।
রাশিয়ান নাগরিক মেক্স ও নিকালয়, ইউক্রেনীয় নাগরিক শোবা এবং বেলারুশ নাগরিক সোভেনিয়ারসহ কয়েকটি দেশের একাধিক নাগরিক জানান, তারা বাংলাদেশে ভালো আছেন। খুব সুন্দর ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করছেন। এদেশীয় সরকার তাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা করে আসছে। বর্তমানে তাদের পরিবার পরিজনও রাশিয়া ও ইউক্রেনে এখন পর্যন্ত ভালো আছেন দাবি করে তারা বলছেন, আমরা সব সময় তাদের সাথে যোগাযোগ করছি।
রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের রাশিয়ান ও ইউক্রেন নাগরিকদের বাসস্থলের আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা জানান, রূপপুরে কর্মরত রাশিয়ান ও ইউক্রেন নাগরিকেরা কর্মক্ষেত্রে স্বাভাবিক থাকলেও ৩/৪ দিন হলো তাদের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তার ছাপ পড়েছে। তারা রুম থেকে এখন একটু কম বের হচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করলে তারা বলেন যুদ্ধের কারণে দেশে থাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের জন্য একটু চিন্তায় রয়েছেন। ব্যবসায়ীরা আরো জানান, তাদের বিভিন্ন সৌখিন জাতীয় পণ্য বিক্রি কমে গেছে। তারা শপিং করতে আগের মতো বের হচ্ছে না। দুই চার জন বের হলেও শুধু নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনে ফিরে যাচ্ছেন।
শনিবার (৫ মার্চ) সকালে ও দুপুরে পাবনা শহরের আব্দুল হামিদ রোড, প্রেসক্লাব সড়ক, বড় বাজার, নিউ মার্কেট, মিষ্টান্ন, ফল, বস্ত্র বিতানসহ বিভিন্ন স্থানে হাসি খুশিতেই ঘুরতে দেখা যায় রাশিয়ান ও ইউক্রেনীয় নাগরিকদের। একে অপরের মধ্যে ছিল সৌহার্দপূর্ণ আচরণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ দৃশ্যপট।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক লগ্নি প্রতিষ্ঠানে অর্থনৈতিক মন্দাভাব বিরাজ করছে এমন খবর দেশিবিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরেই রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও অনেক বিল বকেয়া রয়েছে। এই বিল বকেয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে কিছুটা চিন্তা থাকলেও দুদেশের যুদ্ধের খড়গ নতুন করে চিন্তিত করে তুলেছে তাদের।
অন্যদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কোনো প্রকার শঙ্কা নেই এমন দাবি জানিয়ে রাশিয়ান রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটম পহেলা মার্চ এক বার্তা পাঠিয়েছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না। নির্ধারিত সময়েই শেষ হবে প্রকল্পের কাজ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ও কাজের সময়সূচিতে কোনো পরিবর্তন হবে না। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরই এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট চালুর কথা রয়েছে। এটি দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র। যা রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মাণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় বলছে, দ্রুত গতিতে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। গত বছরের অক্টোবরে স্থাপন করা হয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল অংশ রিঅ্যাক্টর প্রেশার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লি।
প্রকল্পটির দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। আর দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে ২০২৪ সালে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর ৯০ শতাংশই ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া।
অপর একটি সূত্র বলছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়া সরকারের দেওয়া ঋণের বড় অংশ আসছে সে দেশটির ভিবি ব্যাংক থেকে। রাশিয়ার যে প্রতিষ্ঠানগুলো পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়েছে, তার মধ্যে ভিবি ব্যাংকও রয়েছে। এর ফলে রাশিয়া আর্থিকভাবে বেশ চাপে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। কিন্তু রাশিয়ান রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রোসাটম তাদের দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এমন শঙ্কার কোন কারণ নেই বলে জানিয়েছে।