ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই ৩৫ বছর বয়সী জান্নাতুল সরকার চম্পা বেড়িয়ে পড়েন পাঠকের ঘরে সংবাদ পত্র পৌঁছে দিতে। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে হন্যে হয়ে খুঁজেও ছোটোখাটো কোনো চাকরি পাননি তিনি। যে সময় তার স্বামী-সন্তান নিয়ে সুন্দর জীবনযাপন করার কথা। সে সৌভাগ্য না হওয়ায় এবারে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন ইউপি নির্বাচনে। পেয়েছেন অভাবনীয় সফলতা।
সমাজের নানা প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে জীবন জীবিকার টানে পাবনার চাটমোহর পৌর শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে সাইকেলে চেপে খবরের কাগজ বিক্রি করা চম্পা এবার ইউপি নির্বাচনে সংরক্ষিত নারী ইউপি সদস্য হয়ে সবাইকে তাক লাগিয়েছেন। উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের ৩, ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত (২) আসনে এলাকার সাধারণ মানুষ তাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছেন।
সদ্য সম্প্রতি শেষ হওয়া তৃতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে খবরের কাগজের ফেরিওয়ালা চম্পা হলেন নারী ইউপি সদস্য। তিনি মোট ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ২৮৫। এর আগে পর পর দুই বার ইউপি নির্বাচনে নারী সদস্য হিসেবে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে স্বল্প ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন। তবে দমে যাননি এই সংগ্রামী নারী।
জানা গেছে, জান্নাতুল সরকার চম্পা উপজেলার পার্শ্বডাঙ্গা ইউনিয়নের মল্লিক বাইন গ্রামের ইসহাক আলী সরকারের মেয়ে। বাবাও ছিলেন ইউপি সদস্য। ২০০০ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কিছু একটা করবেন এবং নিজে স্বাবলম্বী হবেন এই আশায় একটি চাকরির খোঁজ করতে থাকেন চম্পা।
২০০২ সালে ঈশ্বরদী আলহাজ্ব টেক্সটাইল মিলে নিরাপত্তা বিভাগের হাবিলদার হিসেবে চাকরি নেন। ২০০৫ একই উপজেলার ডিবিগ্রাম ইউনিয়নের কাঁটাখালী গ্রামে জনৈক এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয় চম্পার। বেশ ভালোই চলছিল সংসার। বিয়ের পর সেই চাকরি ছেড়ে একটি বিমা কোম্পানিতে চাকরি নেন। তবে বছর না পার হতেই স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বিচ্ছেদ হয় তাদের। চম্পা চলে আসেন বাবার বাড়িতে। এদিকে বাবার পরিবারের আর্থিক অবস্থাও ভালো না। পরিবার থেকে আবারও তাকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন সবাই। কিন্তু সংসার জীবনের ওপর তার ভীষণ অনীহা জন্মে। আর ঘর বাধেননি তিনি। এর মধ্যে মারা যান বাবা। মা ও ছোট ভাইয়ের দায়িত্বটাও কাঁধে চাপে চম্পার।
এরপর উপায়ান্তর না পেয়ে প্রায় এক যুগ আগে শুরু করেন পত্রিকা বিক্রি। সাইকেল চালিয়ে চষে বেড়ান পুরো শহর। শিশু থেকে শুরু করে সবাই এক নামে চেনে খবরের ফেরিওয়ালা চম্পাকে। প্রতিদিন প্রায় ২০-২৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে খবরের কাগজ বিক্রি করে পরিবারকে অন্নের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন সংগ্রামী এই নারী।
ভোটারদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চম্পা বলেন, “পর পর দুই বার ভোটে হেরে আমি দমে যাইনি। মানুষের মন জয় করার চেষ্টা করেছি। নিজের জীবনের সংগ্রাম দেখেই বুঝেছি একজন নারীর কতো ধরণের সমস্যা। তাই এবারও ভোটে দাঁড়িয়েছি। মানুষ ভালোবেসে আমাকে বিজয়ী করেছে। আমি অবহেলিত নারীদের নিয়ে কাজ করতে চাই। আশা করি সবার সহযোগিতা পেলে সেটা আমি পারব।”