রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে দেশব্যাপী যে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তার প্রভাব রাজধানী ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার অদূরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জে বাংলার দাবিতে গঠিত হয় মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৪৮ হতে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত এই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে। মূলত মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার তেরশ্রীতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তেরশ্রী কে. এন. ইনস্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী এই আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন।
প্রমথ নাথ নন্দীর সঙ্গে যুক্ত হন একই বিদ্যালয়ের ক্রীড়াবিষয়ক শিক্ষক আফছার উদ্দিন আহম্মেদ। এদের দুজনের প্রেরণায় আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হতে থাকে আন্দোলন। মানিকগঞ্জে মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকেন প্রগতিশীল ছাত্র ও ব্যক্তিগণ। সে সময়ে মানিকগঞ্জ কেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলনে যারা অংশগ্রহণ করে তারা হলেন তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী, ক্রীড়া শিক্ষক আফছার উদ্দিন আহম্মেদ, কলেজ শিক্ষার্থী প্রমথ নাথ সরকার, ডা. মোবারক আলী, ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ডা. আব্দুল সালাম, তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশনের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী আব্দুল হাকিম, আব্দুর রহমান ঠাকুর, মনিন্দ্র নাথ সরকার, সিরাজ উদ্দিন মৃধা, নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিরান উদ্দিন, মো. ওয়াজ উদ্দিন, মো. রেহাজ উদ্দিন।
মানিকগঞ্জ সদরের যারা ছিলেন তারা হলেন ডা. সামসুর রহমান, আনোয়ার আলী চৌধুরী, ওয়ারেশ উদ্দিন পাশা, জাফর আলম চৌধুরী, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন।
আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার হুলিয়া জারি করে। সকল আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার এড়িয়ে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তারপরও পাকিস্তান সরকার কড়া নজরদারি রাখে আন্দোলনকারীদের ওপর। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হঠাৎ করে তেরশ্রী কে. এন. ইনস্টিটিউশনের চার শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে।
এরই ধারাবাহিকতায় ঘিওরের তেরশ্রী স্কুল মাঠে, মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে হাইস্কুল সংলগ্ন স্থানে, সিংগাইরের চারিগ্রামে গণপ্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মানিকগঞ্জে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যাঁরা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে প্রমথ নন্দী, মুনীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য, অরুণ রায় উকিল, প্রিয়নাথ সরকার, নিখিল রঞ্জন ভট্টাচার্য (দক্ষিণাবাবু), সমবায় পরিদর্শক সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, ডা. সামসুর রহমান উল্লেখযোগ্য।
প্রমথ নন্দী বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালে ১৯৪৮ সালে তেরশ্রীতে এক ছাত্র জনতার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে ছাত্র জনতার এক বিরাট মিছিল ঘিওরসহ বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে।
১৯৪৯ সনের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি পুলিশ প্রশাসন তেরশ্রী কে এন ইনস্টিটিউশন থেকে মো. ওয়াজ উদ্দিন, মো. রেহাজ উদ্দিন, ভূপেন্দ্র নাথ দাশ (হাসী), মনিন্দ্র নাথ সরকারকে গ্রেপ্তার করে।
১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে তীব্রতা পায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র জনতার মিছিলে পুলিশ কোনো সতর্কাবস্থা ঘোষণা ছাড়াই গুলিবর্ষণ করলে মানিকগঞ্জের রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আন্দোলনকারী শহীদ হন। শহীদ রফিক উদ্দিনের মাথার পেছনে গুলি লাগে এবং মাথার পিছনের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ উড়ে যায়। শহীদ রফিক সিংগাইর উপজেলার বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আইকম পাস করে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ২১ ফেব্রুয়ারির ঢাকার মিছিলে মানিকগঞ্জের খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, আ. সালাম, মীর আবুর খায়ের (ঘটু) উপস্থিত ছিলেন। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আ. সালাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঢাকার মিছিলে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তীব্র গণজাগরণ গড়ে ওঠে।
১৯৫২ সনে ২১ ফেব্রুয়ারির পর ভাষা শহীদদের স্মরণে মানিকগঞ্জের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঢাকার অনুরূপ শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। কিন্তু সরকারি কর্তৃপক্ষ পুলিশের সহায়তায় সবগুলি শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ নির্মাণে কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আ. লতিফ বিশ্বাসের বাসার সামনে শহীদ মিনার তৈরি করে। ১৯৫২ সাল থেকে অদ্যাবধি ঐ শহীদ মিনারটি মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে টিকে আছে।