‘মুসলমানদের রক্ষায়’ সিলেট থেকে গোপনে আফগানিস্তানে পাড়ি জমানো আব্দুর রাজ্জাক (২০) দীর্ঘ দিন ধরে জিহাদি ভিডিও দেখে তালেবানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বলে জানা গেছে।
তিনি বাংলা ছাড়াও শিখেছিলেন ৩টি ভাষা, যার মধ্যে আছে উর্দু ও আরবি। তিনি প্রায়ই বলতেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। মুসলমানদের জন্য কিছু একটা করা দরকার।
এসব তথ্য জানিয়েছেন রাজ্জাকের বড় ভাই সালমান খান। সিলেট নগরের লামাবাজার এলাকায় বড় ভাইয়ের বাসায় বসবাস করলেও রাজ্জাকের বাড়ি কুমিল্লার বাঙ্গরাবাজার থানায়। তার বাবার নাম পৈরম খান।
সালমান খান বলেন, দীর্ঘদিন থেকে সিলেটে থাকলেও করোনাকালে পরিবারের সবাইকে বাড়িতে (কুমিল্লায়) পাঠিয়ে দিই। তখন রাজ্জাকও বাড়িতে চলে যায়। কিছুদিন পর আমিও বাড়িতে যাই বেড়াতে। হঠাৎ একদিন রাজ্জাক সিলেটে যায় তার বন্ধু ফরিদের সঙ্গে দেখা করতে। ফরিদ, রাজ্জাক আর শিব্বির নামের এক ছেলে খুব ভালো বন্ধু ছিল। রাজ্জাক ছাড়া বাকি দুজনই মাদ্রাসার ছাত্র। ফরিদ থাকত সিলেট নগরের ভাতালি মসজিদ কোয়ার্টারে। রাজ্জাক সিলেটে আসার দুই দিন পর আমিও সিলেটে আসি। এরপর রাজ্জাক আমার বাসায় এসে মাত্র ১০ মিনিট আমার সঙ্গে বসে কথা বলে। তারপর চলে যায় ফরিদের কাছে। রাতে ফরিদের সঙ্গে থেকে পরদিন ২৩ মার্চ সে বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশে বের হলেও তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরে কোনো খোঁজ না পেয়ে আমি জিডি করি। জিডি করার সময় ফরিদ আমার সঙ্গে ছিল।
তিনি বলেন, আমার ভাই রাজ্জাক, ফরিদ আর দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লালাবাজার এলাকার শিব্বির সারাক্ষণ এক সঙ্গে চলাফেরা করত। ইসলামি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তারা জড়িত ছিল। কিন্তু এই দলের লোকজন ‘হক কথা’ বলে না দেখে বেশ আগে তারা দল ছেড়ে দেয়। আমার ভাইয়ের নিখোঁজের পর শুনলাম শিব্বিরও নিখোঁজ। এর কিছুদিন পর এক রাতে ঢাকা থেকে পুলিশের একটি দল এসে ফরিদকে ধরে নিয়ে যায়। আর রাজ্জাকের খোঁজ মেলেনি।
সালমান খান বলেন, রাজ্জাক সিলেট নগরের দাড়িয়াপাড়াস্থ দি এইডেড হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক শেষ করে রিকাবিবাজারস্থ মদন মোহন কলেজে ভর্তি হয়। সে সারাক্ষণ আফগানিস্তানের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকত। আফগানিস্তান আর তালেবানের ব্যাপারে অনেক কিছুই বলত। খুব চিন্তা করত সে। আর সব সময় জিহাদি বিভিন্ন ভিডিও দেখত। সব সময় বলত, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে। মুসলমানদের জন্য কিছু একটা করা দরকার। কিন্তু আমি খুব একটা গুরুত্ব দিইনি। রাজ্জাক, ফরিদ, শিব্বির এরা সবাই নানা রকম লেখালেখি করত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এরা অনেক উগ্রবাদী ছিল।
তিনি বলেন, আমরা প্রথমে দাড়িয়াপাড়া এলাকায় থাকতাম। নামাজে যাওয়ার মাধ্যমে ফরিদের সঙ্গে রাজ্জাকের সঙ্গে পরিচয় হয়। আমার ভাই অনেক মেধাবী ছিল। অনলাইনের মাধ্যমে সে উর্দু, হিন্দি এবং ইংরেজিতে পারদর্শী হয়েছিল।
সালমান খান বলেন, চার মাস আগে পুলিশের একজন আমাকে বলেছিলেন রাজ্জাক তালেবানে যোগ দিয়েছে। আমি জানলেও পরিবারের কাউকে জানাইনি। কিন্তু এখন সবাই জেনে গেছে। আমার বাবা-মা অনেক কান্নাকাটি করছে। তাদের অবস্থা অনেক খারাপ। রাজ্জাক এমন করবে কখনো ভাবিনি।
ভাতালি মসজিদের মুয়াজ্জিন শামসুল হক বলেন, ফরিদ থাকত ৮ নম্বর কক্ষে। গত রমজান মাসে ঢাকা থেকে পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে গেছে। রাজ্জাক, ফরিদ আর শিব্বির নামের একটা ছেলে বেশিরভাগ সময় একসঙ্গে চলাফেরা করত। ফরিদ প্রায় ৩ বছর থেকে এখানে থাকছিল। আগে সে মাদ্রাসায় পড়ালেখা করলেও পরে বাদ দিয়ে প্রাইভেট পড়াত। আর লালাবাজার এলাকার শিব্বির নামের একটি ছেলে আসত। সে কোনো একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করত। শুনেছি সেও নিখোঁজ।
এ ব্যাপারে কথা বলতে শিব্বিরের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি।
সিলেট মহানগর পুলিশের কোতোয়ালি থানায় করা জিডি সূত্রে জানা যায়, রাজ্জাক গত ২৩ মার্চ নিখোঁজ হন। পরে ১ এপ্রিল সাধারণ ডায়েরি করেন তার ভাই সালমান খান।
ওই জিডির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই টি এম আল আমিন বলেন, জিডি করার পর আমরা অনেক চেষ্টা করেও রাজ্জাকের কোনো খোঁজ পাইনি। কিছুদিন পর শুনলাম, যে ফরিদের বাসায় বাসায় যাওয়ার উদ্দেশে রাজ্জাক রওনা হয়েছিল তাকে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানার সন্ত্রাসবিরোধী একটি মামলায় ধরে নিয়ে গেছে সেখানকার পুলিশ। সে এখন কাশিমপুর কারাগারে আছে।
তিনি জানান, ফরিদ উদ্দিন মৌলভীবাজার জেলার নারায়ণপাশা এলাকার হাফিজ উদ্দিনের ছেলে।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট জানিয়েছে, প্রথমে ভারতে যান রাজ্জাক। এখন তিনি আফগানিস্তানে অবস্থান করছেন। তার সঙ্গে আরও অনেক বাংলাদেশি যুবক আছেন এবং সেখানে তালেবানদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন তারা।
সিটিটিসি জানায়, প্রথমে ভারত, এরপর পাকিস্তান হয়ে তিনি আফগানিস্তান পৌঁছেন। হিজরতের নামে তালেবানদের সঙ্গী হয়ে যুদ্ধ করাই তার মূল উদ্দেশ্য। রাজ্জাক শুধু একাই যাননি, তার মতো আরও অনেক যুবক হিজরতের নামে গ্রুপ করে তালেবানদের ডাকে আফগানিস্তানে যাচ্ছেন।