সাতক্ষীরার বেলে, দোঁয়াশ মাটি ও নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু কুল চাষের জন্য় বেশ উপযোগী। ধান, পাট, সবজি ও মাছ চাষ অপেক্ষাও কুল চাষে অধিক লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা। তাই কুল চাষে ঝুঁকে পড়েছেন অধিকাংশ কৃষক। চলতি বছর কুল চাষ বেড়ে যাওয়ায় সাতক্ষীরা কুল চাষের সম্ভাবনাময় জেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
সাতক্ষীরার স্থানীয় কৃষকরা জানান, জেলায় এ বছর ৬৫০ হেক্টর জমিতে কুল চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে কলারোয়া, তালা, সাতক্ষীরা সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি কুল চাষ হয়েছে। গত বছর জেলায় ৬০০ হেক্টর জমিতে কুল চাষ করা হয়।
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ধান, পাট ও সবজির উৎপাদন কমে যাওয়ায় জেলার কলারোয়া উপজেলার সিঙ্গা, হুলহুলিয়া, বহুড়া ও সাতপোতা এলাকায় ১৯৯৫ সাল থেকে বাণ্যিজিক ভিত্তিতে নারিকেল কুল, বাউকুল, আপেল কুল, বলসুন্দরী ও ঢাকা নাইন্টি কুল চাষ শুরু হয়। এসবের মধ্যে নারিকেল কুল সুস্বাদু ও বাজারে বেশি দামে বিক্রি হয়। কুল বিক্রি করে কৃষকরা অধিক লাভ পাওয়ায় বর্তমানে উপজেলার বেড়বেড়ি, দরবাশা, কোমরপুর , নাথুপুর, বলিয়ানপুর, সোনাবাড়িয়া, রামকৃষ্ণপুর, বড়ালি, হিজলদি, সুলতানপুর, দাঁড়কি , চাঁন্দুড়িয়া ও কাতপুরসহ শতাধিক গ্রামে কুল চাষ হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় তালা, সাতক্ষীরা সদর, দেবহাটা ও পার্শ্ববর্তী যশোর জেলার শার্শা ও ঝিকরগাছা উপজেলার দেড় শতাধিক গ্রামে এ চাষ শুরু হয়।
বাংলা সনের ফাল্গুন মাসের শেষের দিক থেকে পুরোনো কুলগাছের ডাল কেটে জমিতে সেচ ও পরিচর্যার কাজ শুরু করেন কৃষকরা। কার্তিক মাসের প্রথম দিকে কুল গাছে ফুল ধরার পর বিভিন্ন কীটনাশক স্প্রে করা হয়। এ সময় কুল ফুলে মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়ন ঘটে। অগ্রহায়ন মাসের প্রথম দিকে গাছে কুল ধরা শুরু হলে স্বাস্থ্য হানিকর নয়, এমন হরমোন স্প্রে করা হয়। পৌষ মাসের শুরুতেই কুল পাকতে শুরু করে। শেষ ফাল্গুন পর্যন্ত কুল পাওয়া যায়।
কৃষকরা জানান, বিঘাপ্রতি মৌসুমে ৫০ থেকে ৫৫ কুইন্টাল কুল পাওয়া যায়। বর্তমানে নারিকেল কুল কেজি প্রতি ৯০ থেকে ১০০ টাকা ও আপেল কুল ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। টক কুল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়। কলারোয়ার সিঙ্গা বাজার, তালার পাটকেলঘাটা ও সাতক্ষীরা শহরের বড় বাজারসহ কয়েকটি ডিপোর মাধ্যমে উৎপাদিত কুল জেলার চাহিদা মিটিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ মেট্রিক টন ঢাকার কারওয়ান বাজার, ওয়াইজঘাট, চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়।
জেলায় প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার এবং ১৫ হাজারের বেশি নারী ও পুরুষ শ্রমিক এসব কুলবাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি সহায়তায় পর্যাপ্ত পরিমাণ কম সুদে বা সুদমুক্ত ঋণ না পাওয়ায় তারা ঢাকার ওয়াইজঘাট ও কারওয়ান বাজারের মহাজন বা ফড়িয়াদের কাছ থেকে দাদন নিতে বাধ্য হন। ফলে ওই সব ফড়িয়ার কাছে কুল দিয়ে তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
অপর দিকে সরকারিভাবে বাজারজাতকরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যবস্থা (আচার ও জেলি তৈরি) না থাকায় উচ্চ মূল্যে পরিবহন খরচ গুনতেও হয় বলে অভিযোগ করেন কৃষকরা।
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, কুল একটি মৌসুমি ফল। নারিকেল কুল, বাও কুল, আপেল কুল, বল সুন্দরী ও নাইন্টি কুল চাষ হচ্ছে। মাছের ঘেরের আইল ও পতিত জমিতে কুল চাষ হচ্ছে। এবার ৬৫০ হেক্টর জমিতে কুল চাষ হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে কুল চাষ করতে খরচ হয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা, যা বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকায়। আবহাওয়া ভালো থাকলে কুল চাষে আরও বেশি লাভ হবে।
দেশের চাহিদা মিটিয়ে কুল বিদেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।