কুমিল্লার জগন্নাথ দেবের মন্দির বা সতেরো রত্ন মন্দির। জেলার আদর্শ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের খামার কৃষ্ণপুর গ্রামে অবস্থিত। কারও মতে সতেরোটি রত্ন এটিতে স্থান পাওয়ায় নাম দেওয়া হয় সতেরো রত্ন মন্দির। কারও মতে, ১৭টি চূড়ার কারণে এর নাম দেওয়া হয় সতেরো রত্ন মন্দির। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি তীর্থস্থান হিসেবে বিবেচিত। চার শ বছরের প্রাচীন মন্দিরটি দেখতে প্রতিদিনই মানুষ ভিড় করছে সেখানে। বর্তমানে মন্দিরটি সংরক্ষণ করছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
মন্দির সূত্র জানায়, সতেরো রত্ন মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ত্রিপুরার মহারাজ দ্বিতীয় রত্ন মাণিক্য বাহাদুর। ১৬৮২-১৭১২ সালের মধ্যে তিনি কুমিল্লায় জগন্নাথ দেবের মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে ১৭৬১ সালে কৃষ্ণ মাণিক্য বাহাদুর সতেরো রত্ন মন্দির নির্মাণকাজ সম্পন্ন করেন। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত মন্দিরটি বাংলার টেরাকোটা স্থাপত্যের নিদর্শন বহন করে। অষ্টকোণ আকৃতির স্থাপত্য পরিকল্পনার এই মন্দিরটি সতেরো চূড়াবিশিষ্ট হলেও বর্তমানে অধিকাংশ চূড়া ধ্বংস হয়ে গেছে। মন্দিরের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় আটটি করে ১৬টিসহ চূড়ার সংখ্যা ১৭টি ছিল। মন্দিরটির ব্যাস ৫২.০৫ মিটার। বাইরের দিক থেকে তিনতলা মনে হলেও মন্দিরটির ভেতরের দিক থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত ওঠা যায়। প্রথম তলার উচ্চতা প্রায় ৪.০৫ মিটার। ২.১০ মিটার উঁচু চারটি প্রবেশপথ দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করা যায়। প্রবেশপথের দুই পাশে রয়েছে নকশা। দ্বিতীয় তলায় ছয়টি জানালা রয়েছে। মন্দিরের প্রতিটি ধাপে রয়েছে নকশা। এ ছাড়া মন্দিরটিতে ফুল, লতাপাতা, ঘণ্টা ও জ্যামিতিক নকশায় অলংকৃত করা হয়েছে।
মন্দির এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ছায়াঘেরা পরিবেশ। গাছে গাছে ডাকছে বিভিন্ন পাখি। মন্দিরে পূজায় ব্যস্ত লোকজন। প্রাচীন মন্দিরটি দেখতে এসেছেন কয়েকজন। প্রাচীন মন্দিরটির পাশে বর্তমানে রয়েছে আরেকটি মন্দির। রয়েছে তুলসীতলা প্রার্থনা বেদী। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) কুমিল্লা শাখার কার্যালয় রয়েছে। এখানে প্রতিবছর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
ইসকন কুমিল্লা শাখার উপদেষ্টা সদাশিব সিংহ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, “জনশ্রুতি রয়েছে ১৭টি মূল্যবান রত্ন স্থাপন করা হয়েছে মন্দিরটিতে। সেই রত্ন চুরি করতে চোর মন্দিরের চূড়ায় ওঠে। নামার সময় মন্দিরের ভেতরের গর্তে পড়ে যায়। মন্দির থেকে পাশের পুকুরে সেই গর্তের সংযোগ রয়েছে। চোর বাঁচার জন্য সেই গর্তে দিয়ে পুকুর পর্যন্ত চলে আসে। কয়েক দিন পর তার মৃতদেহ পুকুরে ভেসে ওঠে। এদিকে ত্রিপুরার রাজাকে স্বপ্নে জগন্নাথ দেব বলেন, এখানে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এই মন্দিরে আর তিনি সেবা পূজা নিতে পারবেন না। তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। মন্দির নির্মাণের প্রায় দেড়শ’ বছর পরে ওই ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে মন্দিরটি অব্যবহৃত রয়েছে। বর্তমানে মন্দির ও আশপাশের এলাকায় ২৫ একর জমি রয়েছে।”
নগরীর রানীর দিঘির পাড়ের বাসিন্দা কালিপদ দেবনাথ বলেন, “মন্দিরটির সৌন্দর্য এখনো চোখ জুড়ায়। এটি সংস্কার করে পাশের পুকুরটিসহ পর্যটন এলাকা গড়ে তোলা যেতে পারে।”
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, ১৭টি চূড়ার কারণে এর নামকরণ করা হয় সতেরো রত্ন মন্দির। মন্দিরটি মধ্যযুগের স্থাপত্যশিল্পের অপূর্ব নিদর্শন। এটিকে আরও সংস্কার করে প্রত্ন পর্যটন বিকাশে টিকিটের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।