সালে দেবুসি'র নিভে যাওয়া আর আবারো জ্বলে ওঠা আলোটার মাঝে সময়ের ব্যবধানটা ১ ঘন্টা ৪৭ মিনিট। তবে অনুভবের পার্থক্যটা আলোকবর্ষ। জ্বলে ওঠা এমন আলোতেই বুঝি লুকিয়ে থাকে 'অপার্থিব' শব্দটি!
কানে ছবি প্রদর্শনী শেষে দর্শক দাঁড়িয়ে হাততালি দেবে। অভিনন্দনে ভাসাবে কলাকুশলীদের। এটি ঐতিহ্য। আবার আছে 'দুয়ো' দেবার সংস্কৃতিও।
তবে অর্থনৈতিক আর চলচ্চিত্র শক্তিতে পিছিয়ে থাকা কোন দেশের চলচ্চিত্র যখন পৌঁছে যায় বিশ্ব আসরে, তখন পিঠ চাপড়ে দেবার এই সংস্কৃতিটা পায় বিশেষ গুরুত্ব। বরাবরই দেখেছি, আফ্রিকা কিংবা উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে আসা ছবির প্রিমিয়ার শেষে হাততালিটা বেশ দীর্ঘ হয়। সৌজন্য বোধটা ঠেকে অনেকটা বিজ্ঞাপনের মতো। টানা ১৫ মিনিটের হাততালি দেখবার অভিজ্ঞতাও এই কানেই হয়েছে আমার। অথচ সেই ছবির ঝুলিতে কোন সম্মাননা না জোটার হতাশাও দেখতে হয়েছে। অবশ্য, সম্মাননা পাবার বিষয়টি দর্শক হাততালির সাথে সরলীকরণ করতেও আমি রাজি নই।
৭ জুলাই কান সময় দুপুর ১২.৫০ এ 'সালে দেবুসি'ও মুখর হয়েছে দর্শকের মূর্হমূর্হ করতালিতে। দাঁড়িয়েও দর্শক অভিনন্দন জানিয়েছেন 'টিম রেহানা মরিয়ম নূর'কে। যেমনটা অন্য দেশের অন্য কোন ছবির ক্ষেত্রে, ঠিক তেমনটাই। সেই হাততালির সারিতে আমিও তো কখনো কখনো শামিল হয়েছি।
তবু এ যেন বিশেষ। তাই এই আলো 'অপার্থিব'। তাতে ম্লান হাজারো দর্শকের করতালি। তাতে স্নাত 'টিম রেহানা মরিয়ম নূর'। তাতে উজ্জ্বল 'বাংলাদেশ' নামখানি।
আপ্লুত সাদ বাহিনী। পর্দায় দৃঢ় মনোবলে অদ্ভুত রসায়ন বুনে দেয়া, 'রেহানা'র চোখে জল!
একেই কি বলে আনন্দ অশ্রু? কাঁদছেন আজমেরী হক বাঁধন। তাকে ঘিরে দর্শকের হাততালি থামছিল না।
অভূতপূর্ব। অতুলনীয়।
পেশাদারিত্বের আড়ালে আবেগকে মুছে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেছি 'এক্সিট' গেইটে। জানতে চেয়েছি, দর্শকের অনুভূতি।
এই দর্শকের বেশীর ভাগই একাত্ম হয়েছেন 'রেহানা' চরিত্রের সঙ্গে। রাশিয়া, ইরান কিংবা বলিভিয়া-সব অঞ্চলের দর্শকই এক কথায় বলেছেন, 'ইট ওয়াজ কমিউনিকেটিভ'।
কেউ বলেছেন, ছবিটি তাকে ইমোশনাল করেছে। কেউ বলেছেন, 'ইট ওয়াজ এন এমেজিং মুভি উইথ স্ট্রং মেসেজ'। আবার কেউ বলেছেন, 'এটি শুধু বাংলাদেশেরই গল্প নয়। এটি আমাদেরও গল্প। আমারও গল্প'।
দর্শক প্রতিক্রিয়া নিয়েই ছুটলাম আপ্লুত 'টিম রেহানা মরিয়ম নূরে'র কাছে।
বাঁধনের চোখে তখনও জল। বললেন, 'আমি অভিভূত। স্ক্রিনে রেহানার বেদনা, আর স্ক্রিনের বাইরে আমার বেদনা-অনুভব করে দর্শক আমাকে যেভাবে ভালোবাসায় ভরিয়েছে, তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। এভাবে সবাই দেখেছে। এভাবে সবাই গ্রহণ করেছে। এটি আসলে বলে বোঝাবার নয়'।
ছবির নির্বাহী প্রযোজক এহসানুল হক বাবু তো বলেই ফেললেন, 'এমন সাড়া প্রত্যাশাতীত'।
তবে ছবির পরিচালক আবদুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ, যার প্রতিক্রিয়ার জন্য মুখিয়ে ছিলাম,
এমন দিনেও তিনি কথা বললেন না গণমাধ্যমের সঙ্গে। একটু মন খারাপ তো হলোই।
সেই মন খারাপেরও জায়গা হলো না, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এমন উত্তুঙ্গ খবর তৈরির মসলায়।
দ্রুত স্টোরি তৈরি করলাম। যুক্ত হলাম সরাসরি।এর মাঝেই 'সালে দেবুসি'তে সাদ বাহিনীর প্রতি দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানানোর ভিডিও ছবি 'ডি ডব্লিউ'র মাধ্যমে ছড়িয়ে পরেছে সোশাল মিডিয়ায়। বইছে অভিনন্দন আর প্রশংসার বন্যা।
শুধু ঢাকা থেকেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সাংবাদিক, চলচ্চিত্রপ্রেমীরা মেসেঞ্জার আর হোয়াটসঅ্যাপে জানতে চাইছেন প্রদর্শনীর নানা খুঁটিনাটি। ঢাকার বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমই তাদের স্টোরি সাজাতে যোগাযোগ করছিল বারবার আমাদের সঙ্গে। ব্যস্ততায় মেশানো এক অদ্ভুত সময় পারি দিচ্ছিলাম।
চোখ রাখছিলাম বিশ্ব গণমাধ্যমেও। বৃটিশ ম্যাগাজিন স্ক্রিন ডেইলি 'আ ডিরোক্টরিয়াল স্টাইল দ্যটস গ্রিপস লাইক স্টিল' শিরোনামে প্রশংসায় ভাসিয়েছে ছবিটিকে। 'এক্সক্লুসিভ' স্টোরি প্রকাশ করেছে হলিউড রিপোর্টার আর ভ্যারাইটি।
কাভারেজের উত্তেজনা একটু থিতিয়ে আসতেই আমার আর জনি হকে'র মিশন 'হোটেল জি ডব্লিউ ম্যারিয়ট'।
সেখানেই আছেন সকালে সালে দেবুসি জয় করা অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। রিসিপশনে আসার খবর জানিয়ে লবিতে অপেক্ষায় আমরা। একটু পরে ক্যাজুয়াল পোশাকেই এলেন বাঁধন। একটা ফেইসবুক লাইভ হবে।
বাঁধনের ইচ্ছেতেই হোটেল থেকে বেরিয়ে আমরা সমুদ্রের পাড়ে।
'হোটেল জি ম্যারিয়ট'কে পেছনে রেখে ভূমধ্যসাগর পাড়ে মুখোমুখি হলাম বাঁধনের। বিকেলের আলো তখনও চুরি যায়নি। সেই আলোর পুরোটা বাঁধনের চোখে মুখে। তবু সেই আলোর কি সাধ্যি! যে উজ্জ্বল, অপার্থিব আলো সকালে গায়ে মেখেছেন বাঁধন, তা ম্লান করে!
(চলবে)