প্যারিসের ঝকঝকে নীল আকাশ। নতুন স্বাভাবিকে অভ্যস্ত হতে চলা শহর। বিমানবন্দর থেকে ছুটে চলছে ট্যাক্সি। সিঙ্গাপুরের চালকের ইংরেজি ভাষাটা রপ্ত নয়। মোবাইলে লিখে গুগল ট্রান্সলেশন করে নিতে হয়। তবু খুব একটা সমস্যা হলো না কমিউনিকেশনে। জুনের শেষ সপ্তাহ। গরমটা বেশ। তবে এখানে জুলাই নাকি হটার!
আবহাওয়া নিয়ে খুব একটা ভাবছিলাম না। ছুটতে থাকা গাড়িতে বসে ভাবছিলাম, ‘সাত দিনের কোয়ারেন্টিন কেমন করে কাটাব?' এমন ভাবতেই ভাবতেই পৌঁছে গেলাম, সেভারন বুঁদের ‘ভ্যালেন্তিনা টেরেসকোভা’য় আমার নির্ধারিত ঠিকানায়।
ফ্রান্স উদীচীর সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হাওলাদারের আতিথেয়তায় সাত দিন থাকবার পরিকল্পনামতোই এখানটায় আসা। চালকের মোবাইল ফোন থেকে ফোন দিলাম বাসার আরেক সদস্য জুয়েল লেনিনকে। ট্রামস্টেশনের পাশেই অ্যাপার্টমেন্ট। ফোন পেয়ে চলে এলেন। চালককে বিদায় দিয়ে যখন অ্যাপার্টমেন্টের পাঁচতলায় এলাম, জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, আকাশ কালো করেছে।
প্রায় দেড় দিনের ভ্রমণ ক্লান্তি শরীরজুড়ে। দ্রুত শাওয়ার নিয়ে খেতে বসলাম। ডাইনিং টেবিলে বেগুন আলুর ঝোলে উঁকি দিচ্ছিল, ইলিশ! বাইরে তখন ‘ভিনদেশি বৃষ্টি’। আহা!
রসনা আর প্রকৃতি মিলে ‘ব্যাচেলর অ্যাপার্টমেন্টে’ দারুণ অভ্যর্থনা। বুঝলাম, খারাপ যাবে না সাতটি দিন। বেশ কিছু বই নিয়ে এসেছি। তবে এমন বৃষ্টিতে ঘুমানোটাই সই!
একঘুমে রাত গভীর। কাজ থেকে ফিরেছেন সেই কখন শাখাওয়াত ভাই। কিন্তু আমাকে ঘুমাতে দেখে আর ডেকে তোলেননি। ঘুম ভাঙলে, তার রুমে উঁকি দিলাম। এরপরই রাত বাড়ল কফির মগে আড্ডার সমানুপাতিক হয়ে।
রুমেই পৃথিবী। মেসেঞ্জার আর হোয়াটসঅ্যাপে কাটছে অনেকটা সময়। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা প্রকাশ রায়ের বাসায় এর আগে কয়েকবার আতিথেয়তা নিয়েছিলাম। এবার তার বাসায় না ওঠায়, মন খারাপ করলেন দাদা-বউদি দুজনেই। একদিন দাদা চলেও এলেন। কাটিয়ে গেলেন বেশ খানিকটা সময়। প্রায় প্রতিদিনই খবর নিয়েছেন শিল্পী আরিফ রানা আর কুমকুম ভাবি। কানে যাওয়ার আগের দিন এলেন তরুণ নির্মাতা সাঈদ সাহিলও। ফোনে কথা হলো শিল্পী শাহাবুদ্দীন, আনা ভাবি আর মূকাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুমদারের সঙ্গে। সবারই একটা উপদেশ, বের হওয়া চলবে না। কারণ, যেকোনো সময় ইন্সপেকশন হতে পারে।
এই ‘জুজুতেই’ আমার আর বের হওয়া হলো না। জানালায় ঘুরে-ফিরে একটাই ফ্রেম। আকাশ, মেঘ আর মেঘজল। প্যারিসে এত বৃষ্টি আগে দেখিনি। কোয়ারেন্টিইনবাসে সবচেয়ে স্বস্তি ছিল, শাখাওয়াত আর লেনিন ভাইয়ের দারুণ দারুণ রেসিপির ষোলো আনা বাঙালি রান্না। সত্যি, দারুণ!
এর মধ্যেই অনলাইনে কানে যাওয়ার আর ফিরতি টিকিট কেটে ফেললাম। উৎসবের আগের দিন যাওয়া আর উৎসব শেষ হওয়ার পরদিন ফেরা। এমন শিডিউলের কারণে টিকিট বেশ উচ্চমূল্যেই কাটতে হলো।
যোগাযোগ রাখছিলাম ‘টিম রেহানা মরিয়ম নূরে’র সঙ্গেও। সাত সদস্যের দলটিও তখন প্যারিসের আরেক প্রান্তে। দশ দিনের কোয়ারান্টাইনবাসে। নিয়মিত আপডেট পাচ্ছিলাম। প্যারিস থেকেই ‘কোয়ারেন্টাইন আপডেট’ নিয়ো একাত্তরের আনন্দযোগে যুক্ত হলেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন।
৪ জুলাই বিকেলে কিছু সময়ের জন্য বের হলাম। ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে কিছু কেনাকাটা। মনেই হলো না, সাতটা দিন পেরিয়ে গেল।
৫ জুলাই সকালে ট্রেন ছাড়বে প্যারিসের ‘গার দো লিঁও’ থেকে। সকাল ছয়টায় মেট্রোতে ‘সেভরন বুঁদে’ থেকে ‘গার দো লিঁও’ তে। সঙ্গে এলেন জুয়েল লেনিন। স্টার বাক্সের কফির ধোঁয়ায় সকালটা। একটু পরেই দ্রুতগতির ট্রেন ‘উই গো’ তে চড়ে ছুটব কানের উদ্দেশ্যে। সকাল ৭টা ১৮-তে ছেড়ে যাওয়া ট্রেন কান পৌঁছাবে দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে।
লেনিন ভাইকে ‘আ ভোয়া’ (শুভ বিদায়) বলে উঠে পড়লাম ট্রেনে। আমার ভ্রমণ সঙ্গী দুই ফরাসি তরুণ-তরুণী। ছুটি কাটাতে ওরাও ছুটছে দক্ষিণ ফ্রান্সের এন্টিবসে। দারুণ রোমাঞ্চিত এই যুগলের সঙ্গে আড্ডাটা বেশ জমেছিল। মাঝে মাঝেই ব্যাগ থেকে এটা-সেটা বের করে আপ্যায়নটা, সঙ্গটাকে করে তুলেছিল মধুর। কোথা থেকে হাপিশ হয়ে গেল পাঁচটি ঘণ্টা। মাঝে পেরিয়ে গেলাম কত কত বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর শহর। হুঁশ ফিরল, মাঁর্শেইর নীল সমুদ্র দেখে। দক্ষিণ ফ্রান্সের নীল জলের হাতছানি!
(চলবে)