রূপকথার গল্পেও এতটা সাজানো-গোছানো হয় না, যতটা লিওনেল মেসির বর্ণিল ক্যারিয়ারের গল্প এগিয়েছে। মানুষের অর্জন কিংবা উপরে ওঠার শেষ কোথায়? সাফল্য যেন আরও আরও প্রাপ্তিতে। কিন্তু আর্জেন্টাইন মহানায়ক মেসির ফুটবল থেকে আর কি প্রাপ্তি আছে? মহাদেশীয় কিংবা বৈশ্বিক- কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা জয় ই আর বাকি নেই। ক্লাবের হয়ে দু`হাত ভরে পেয়েছেন। ফুটবল যাকে পরিপূর্ণ করেছে তিনি লিওনেল মেসি, সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়।
রোজারিও শহরের ছোট্ট মেসির বড় হয়ে ওঠার গল্প বারবারই আওড়ানো হয়েছে। সে গল্পে পরতে পরতে কষ্টের শেষে আছে মুগ্ধতার রেশও। বার্সেলোনা নামক আশীর্বাদ মেসির মাথার ওপরে ছিল বলেই তিনি মেসি হয়ে উঠেছেন। তাইতো এটাই মেসির ঘর, তার আপন জায়গা। হরমোনের জটিলতা থেকে স্প্যানিশ ক্লাবটি মেসিকে দেখিয়েছেন নতুন সূর্য, পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশ্বের কাছে ফুটবলে রাজত্ব করতে আসা সম্রাটকে।
তবে ফুটবল জাদুকরের শৈল্পিকতার ভীড়ে আফসোসও ছিল। ক্লাবের হয়ে এত এত অর্জন অথচ নেই কোনো আন্তর্জাতিক শিরোপা। নিন্দুকরা তাকে বিদ্রুপ করে ডাকত ‘ক্লাব লিজেন্ড’ বলে। ক্লাবের তাকে থরে থরে উপচেপড়া শিরোপা কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের তাক ধূ ধূ মরুভূমি।
শিরোপার কাছাকাছি যে যাননি মেসি, তেমন নয়। ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে ফাইনালে ১-০ গোলে জার্মানির কাছে হেরে যায় মেসির আর্জেন্টিনা। ম্যাচের পর ট্রফির দিকে তাকিয়ে মেসির আক্ষেপভরা দৃষ্টি পুড়িয়েছে তার কট্টর নিন্দুককেও। ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা ফাইনালে চিলির কাছে পেনাল্টি শ্যুটআউটে হেরে অভিমানে মেসি জানালেন, আর্জেন্টিনার হয়ে আর খেলবেন না৷ বিদায়ের এ ঘোষণা এতটাই আকস্মিক ছিল যে বিশ্বজুড়ে চলছিল বিস্ময়ের ধাক্বা সামলানোর প্রয়াস৷ তবে সমর্থকদের দাবি উপেক্ষা করতে পারেননি, ফিরেছেন আবার সবুজ মাঠে।
২০২১ সালের আগেও মেসির আন্তর্জাতিক শিরোপা খরায় যাচ্ছিল। এবার বোধহয় ফুটবল দেবতা তার পানে মুখ চাইলেন। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে হারিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা ঘরে তুলল আর্জেন্টিনা। ঘুচে গেল আর্জেন্টিনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা। ইউরোপ সেরা ইতালিকে হারিয়ে ফাইনালিসিমার ট্রফিও আর্জেন্টিনা বগলদাবা করল।
রীতিমতো আকাশে উড়ে টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থেকে কাতার বিশ্বকাপের মূলমঞ্চে পা রাখল মেসিরা। ভক্তদের প্রত্যাশার চাপও যাচ্ছিল বেড়ে। উড়ন্ত আর্জেন্টিনাকে টেনে মাটিতে নামাল সৌদি আরব। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচেই ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে বসে মেসিরা। টানা কোপা আমেরিকা, ফাইনালিসিমা এবং বিশ্বকাপ জয়! রূপকথার নায়কও এতটা ভাগ্যবান থাকে না।
কিন্তু এই পরাজয়ই যেন জয়ের পথ লিখল সুদীর্ঘ সময় ধরে। নাটকের চেয়েও নাটকীয়তায় একের পর ম্যাচে মেসিরা প্রমাণ দিলো চ্যাম্পিয়ন হতেই এসেছে। ফাইনালের মঞ্চে অপ্রতিরোধ্য ফ্রান্সকে হারানোর অনেকখানি কৃতিত্ব দিবু মার্টিনেজকে না দিলে অন্যায় হয়ে যায়। আর্জেন্টিনার এই ত্রাতা ই যেন মেসির হাতে তুলে দিলেন বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি। আসরের সেরা খেলোয়াড়ের গায়ে তকমা সেঁটে গেল ‘সর্বকালের সেরা’র।
মেসির ৩৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। একজন ফুটবলার হিসেবে বয়সটা বুড়োই বলা যায়। কারণ এখনই যে অবসরে যাওয়ার সময়! কমে যাচ্ছে তার সবুজ মাঠের ৯০ মিনিটের শৈল্পিকতা। তবে যে পায়ের জাদুর মুগ্ধতায় উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত গোটা প্রজন্মকে তিনি বুঁদ করে রেখেছেন, তার আবেশ ফুরোবে না কখনো, কোনোদিন।
শুভ জন্মদিন লিও, ভালোবাসা নিও।