২০১৭ সালের নভেম্বর, বিপিএলে মুখোমুখি রংপুর রাইডার্স ও চট্টগ্রাম ভাইকিংস। ইনিংসের ১৭তম ওভারে শুভাশিষের ইয়র্কার ঠিকভাবে খেলতে পারেননি রংপুর অধিনায়ক মাশরাফি। ফিরতি বল ধরে থ্রো করতে গিয়েছিলেন শুভাশিষ, এরপর মাশরাফি কিছু একটা বলেন তাকে। সেটার পাল্টা জবাব দিতে মেজাজ হারিয়ে ফেলেন শুভাশিষ। এরপর মাশরাফির দিকে শুভাশিষ এগিয়ে গেলে সতীর্থ তানভীর হায়দার এসে তাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যান।
মুহূর্তেই পুরো দেশের রোষানলে পড়েন শুভাশিষ। দেশের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক ও প্রায় সর্বজন শ্রদ্ধেয় মাশরাফির সঙ্গে তর্ক তখন অনেকেই ভালো চোখে দেখেননি। তবে ম্যাচ শেষে মাশরাফি শুভাশিষকে সঙ্গে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলার কথা জানান। সবাইকে অনুরোধ করেন, শুভাশিষকে নিয়ে বাজে কথা না বলতে।
কাকতালীয়ভাবে এরপর থেকে আস্তে আস্তে ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেন শুভাশিষ। গত ৩-৪ বছর তাকে কোথাও পেশাদার ক্রিকেট খেলতেও দেখা যায়নি। অনেকেই তাই ধারণা করেন, মাশরাফির কারণেই কি ক্যারিয়ার শেষ হয়ে গেল শুভাশিষের!
তবে সংবাদ প্রকাশের মুখোমুখি হয়ে এই অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন দাবি করেছেন শুভাশিষ। তিনি জানান, চোটের কারণেই এত দিন মাঠে বাইরে আছেন। মাশরাফির কারণে তিনি মাঠের বাইরে, এটাও মিডিয়া ও মানুষের তৈরি করা গুজব বলেও দাবি করেন তিনি।
২০১৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় শুভাশিষের। দুর্দান্ত গতি আর লেন্থের কারণে তাকে টেস্ট দলের পেস আক্রমণের ভবিষ্যৎ ভাবা হচ্ছিল তখন। তবে সেই আশা পূরণ হয়নি, মাত্র চার টেস্টেই থেমে আছে তার টেস্ট ক্যারিয়ার। যেখানে তিনি উইকেট নিয়েছেন ৯টি।
এ ছাড়া তার এক বছর আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। তবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ওই ম্যাচটিই তার ক্যারিয়ারে একমাত্র ওয়ানডে ম্যাচ হয়ে আছে।
দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে, মাশরাফির সঙ্গে ঘটনার প্রভাব, নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনাসহ নানা বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে খোলাখুলি আলাপ করেছেন শুভাশিষ। সংবাদ প্রকাশের পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো:
সংবাদ প্রকাশ: প্রিমিয়ার লিগে দেখা যাচ্ছে না, অনেক দিন ফোকাসে নেই। কী করছেন এখন?
শুভাশিষ: বাসায় আছি, ফিটনেস ফিরে পেতে কাজ করছি। মূলত ম্যাচ ফিটনেস না পাওয়াতে প্রিমিয়ার লিগ খেলতে পারছি না।
সংবাদ প্রকাশ: ক্রিকেটে এত লম্বা সময় ধরে বাইরে কেন?
শুভাশিষ: আমার চোট ছিল, মাঝে একটু পারিবারিক সমস্যাও ছিল। যাহোক, মূলত চোটের কারণের এত দিন মাঠের বাইরে আছি। এখন মোটামুটি সুস্থ আছি, বাকিটা ম্যাচ ফিটনেস ফিরে পাওয়ার ব্যাপার আরকি।
সংবাদ প্রকাশ: চোটে বাইরে আছেন, জাতীয় দলের সিনিয়ররা কেউ খোঁজ নিয়েছেন?
শুভাশিষ: আসলে বোর্ড থেকে…ইনজুরিতে পড়লে আসলে! এ বিষয়টা বলা মুশকিল। অনেকের খোঁজখবর নেয়, আবার অনেকের নেয় না। আমিও অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছি, অন্যরা খেলেছে। তবে সবাই তো আর একই রকম সুবিধা পায় না। যেমন আবুল হাসান রাজুকে দুই-তিনবার বোর্ড চিকিৎসা করিয়েছে। আমিও তো অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছি, আবাহনীতে খেলেছি, মোহামেডানে খেলেছি। আসলে অনেক সময় এগুলো হয় না, নিজেরটা নিজেই করে নিতে হয়। কিছু সময় বোর্ড থেকেও সুবিধা পাওয়া যায়। এটা আসলে অনেক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে।
সংবাদ প্রকাশ: আপনার চোটের বিষয়ে তাহলে বোর্ড সাহায্য বা খোঁজ নেয়নি, তাই তো?
শুভাশিষ: না, আসলে আমার যখন সেকেন্ড অপারেশন হয়েছিল বোর্ড তখন সাহায্য করেছিল। যদিও ওটা মাইনর ইনজুরি ছিল। কিন্তু প্রথমটা আমি নিজে থেকেই করেছিলাম। আমার ব্যাক পেইনের ইনজুরিটা অনেক দিনের ছিল। এটাতে অপারেশনের কিছু ছিল না। তবে এই চোট নিয়ে মাঠে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে পারছিলাম না। খোঁজখবর সবাই নেয় আরকি…
সংবাদ প্রকাশ: ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা কী এখন?
শুভাশিষ: আসলে এখন তো মাঠের বাইরে অনেক সময়। তবে ইচ্ছা আছে অন্তত আরও পাঁচ-সাত বছর ঘরোয়া ক্রিকেট খেলার। এরপর নির্বাচকরা জাতীয় দলে ডাকবে কি না, সেটার তাদের ব্যাপার। তবে আমি যদি পারফর্ম করতে পারি, একাই ম্যাচ জেতাতে পারি তাহলে কেন নয়। তবে সবার আগে শতভাগ ফিট হতে হবে আমাকে।
সংবাদ প্রকাশ: লম্বা সময় মাঠের বাইরে থেকে ফেরার পর বাকিদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়াটা কত চ্যালেঞ্জের?
শুভাশিষ: এত বছর ঘরোয়া লিগ খেলেছি যোগ্যতা ছিল বলেই। আমার এখন মূল লক্ষ্য ফিটনেস ফিরে পাওয়া। এরপর মাঠে ফিরে একাই ম্যাচ জেতানোর পরিকল্পনা করতে চাই, এরপর অন্যদিকে ফোকাস। তবে এখন আসলে অনেক কম্পিটেশনও বেড়ে গেছে। তরুণ পেসার আছে দুজন, মুশফিক ও মুগ্ধ। আমাদের রংপুর বিভাগের জন্য এটা ভালো। বয়স একটা ফ্যাক্ট তবে মাঠে পারফর্ম করলে অবশ্যই চ্যালেঞ্জ জানানো সম্ভব।
সংবাদ প্রকাশ: অনেকে ধারণা করে মাশরাফির সঙ্গে সেই ঘটনার কারণে আপনি ক্রিকেটের বাইরে…
শুভাশিষ: না, না (হেসে)। এটা অনেকেই বলে কিন্তু সত্য না। আমি তো চোটের কারণেই মাঠের বাইরে। ওটা কোনো ব্যাপারই না। মাশরাফি ভাই, তখন ক্যাপ্টেন ছিল ঠিক আছে, তার কল ছিল কিন্তু সে তো আর সবকিছু না। আমি পারফর্ম করলে মাশরাফি ভাই ক্যাপ্টেন থাকলেও কিছু করার ছিল না। হ্যাঁ, তার একটা কল থাকেই, কিন্তু তার সঙ্গে আমার কখনোই খারাপ সম্পর্ক ছিল না।
আমরা ছোট থেকে শিখে আসছি, মাঠের বাইরে ভাই হোক বা যে মাঠের ভেতরে ছেড়ে কথা বলা যাবে না। যখন আমার শত্রু আমার দলে খেলবে সে বন্ধু আবার বন্ধু বিপরীত দলে খেললে সে শত্রু। ওনার সঙ্গে ২০০৯ সাল থেকেই খেলছি, তো উনি ভালো করেই জানে আমি কেমন। হ্যাঁ, উনিও তখন ওখানে মাথা গরম করেছে, আমিও তাৎক্ষণিক আমিও করছি।
আর আমি তো জানি মাশরাফি ভাই… হয়তো উনি আমাকে উত্তেজিতো করার জন্য স্লেজিং করছে, আমিও স্লেজিং করছি। যাহোক, মানুষ এখন এটাকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা দেয়, তবে সেটা কোনো ব্যাপার না। খেলোয়াড়দের মধ্যে এটা নিয়ে কিন্তু কেউ কিছু বলেনি। যা বলার সেটা মিডিয়া আর জনগণ বলেছে।
সংবাদ প্রকাশ: এ বিষয়ে তারপর মাশরাফির বিষয়ে আর কখনো আলোচনা হয়েছে?
শুভাশিষ: হ্যাঁ, কতবারই তো কথা হয়েছে। এরপর ওনার সঙ্গে খুব বেশি ওইভাবে যোগাযোগ হয়নি তবে হ্যাঁ কথা তো অবশ্যই হয়েছে। এক একজন একেক ধরনের হয়। মনে করেন, যেমন মাশরাফি ভাই, তামিম ভাই ও রিয়াদ ভাই একসঙ্গে আড্ডা দিতে পছন্দ করে। সাকিব ভাই একটু অন্য রকম।
মুশফিক ভাই আবার আরেকটু আলাদা। জাতীয় দলে মুশফিক ভাইয়ের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল, খাইতে গেলেও উনি আমাকে ডাকতেন। ওনার যেমন একটা সার্কেল ছিল, আমাদেরও ছিল। সাকিব, মুশফিক ভাইয়ের সঙ্গে যেভাবে মিশছি মাশরাফি ভাইয়ের সঙ্গে ওভাবে মেশা হয়নি।
উনি আমার ক্যারিয়ার শেষ করে দেবে ওনার এত ক্ষমতা… হ্যাঁ বাদ দিতে পারবে এক-দুইবার। কিন্তু আমাকে তো খেলা থেকে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। কিছু যে করতে পারবে না তা না… আপনারাও জানেন জাতীয় দলে একটু-আধটু হয়, একেবারেই যে হয় না, তা না। তবে আমি যদি পারফর্ম করি তাহলে কিছুই করতে পারবে না।