“আমি ভাবি, যদি আবার, ছুঁতে পারতাম তোমাকে। সত্যি বা, স্বপ্নই হোক, এ দূরত্ব শেষ হয়ে যেত যে” ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পি অমিত কুমারের এই গানটা কখনো বাংলাদেশি ব্যাটার তাউহিদ হৃদয় শুনেছেন কিনা আমার জানা নেই। তবে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক ওয়ানডের পর শুনতেই পারেন।
অভিষেক ম্যাচে ব্যাট হাতে যেমন আলো ছড়িয়েছেন, তেমনি আউট হওয়ার পর পুড়েছেন ইতিহাসের অংশ না হতে পারার হতাশায়। এ যেন আনন্দ আর দুঃখ মিলেমিশে একাকার। তাইতো এই গানের `তোমাকে` হৃদয়ের কাছে সেই আউট হওয়ার মুহূর্ত, হয়তো বলতে চাইছেন আবার ব্যাট হাতে ওই পরিস্থিতিতে ফিরতে পারলে আর সুযোগ হাতছাড়া হতে দিতেন না।
ব্যাট হাতে তখন সবে তাউহিদ হৃদয় নব্বইয়ের ঘরে পা দিয়েছেন। এরই মধ্যে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো পরিসংখ্যানের পাতায় চোখ বোলাতে। ইনিংসের মধ্যেই জানা গিয়েছে অভিষেক ওয়ানডেতে বাংলাদেশি হিসেবে হৃদয়ের আগে আরও দুই জন ফিফটি করেছেন। কিন্তু হৃদয় তো এবার সেঞ্চুরির পথে, তবে কি এর আগে কোনো বাংলাদেশি অভিষেক ম্যাচে সেঞ্চুরি করতে পেরেছে?
উত্তর যখন ‘না’ আসলো তখন সবাই একটু বেশিই মনোযোগ দিতে শুরু করলেন হৃদয়ের দিকে। সবার অপেক্ষা কখন, হৃদয়ের ইনিংস তিন অঙ্কের ঘরে পৌঁছাবে! কিন্তু যে তাউহিদ পুরো ইনিংস জুড়ে সবার ‘হৃদয়’ জিতলেন তারই যে এভাবে হৃদয় ভাঙবে সেটা কে জানতো। ব্যক্তিগত ৯২ রানে থাকা অবস্থায় হৃদয়ের স্টাম্প উপড়ে ফেলেন আইরিশ পেসার হিউম। তার কিছুক্ষণ আগে যে কিনা ৯৩ রানে সাকিবকেও পুড়িয়েছে সেঞ্চুরি মিসের হতাশায়।
এতো গেল হৃদয় ভাঙা গল্পের শেষাংশ তার আগে তো ছিল পুরোটাই হৃদয় জেতার পূর্ণদৈর্ঘ্য ছায়াছবি। বিপিএল কাঁপিয়ে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে স্কোয়াডে জায়গা পেলেন হৃদয়। কিন্তু ওই সিরিজে যে এক ম্যাচেও একাদশে জায়গা পাবেন না এটা একটু অস্বাভাবিকই ছিল।
এরপর টি-টোয়েন্টি সিরিজে ঠিকই অভিষেক হয়েছে। এরপর আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডের একাদশেও চলে এলেন। তবে জীবনের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে কোথায় ব্যাটিংয়ে নামলেন! দল তখন দ্রুত তিন উইকেট হারিয়েছে, স্কোরবোর্ডে রান মাত্র ৮১। দলে মুশফিক থাকা সত্ত্বেও নামানো হলো তাকে।
এমনিতেই প্রথম ম্যাচ, তারপর পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় তখন পাহাড়সমান স্নায়ুচাপে ভোগার কথা হৃদয়ের। আচ্ছা সত্যি করে বলুন তো, হৃদয়ের ৮৫ বলের ইনিংসে কখনও দেখে মনে হয়েছে চাপে আছে? আমার কিন্তু মোটেও তা মনে হয়নি। বরং মনে হচ্ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পথচলা যে সেই কবে থেকেই।
শুরু থেকেই সাবলীল ভঙ্গিতে রান করে গেছেন হৃদয়। প্রতি বলে তার রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেট আপনাকে মুগ্ধ করবে ম্যাচ জুড়ে। হৃদয় মূলত লাইমলাইটে এসেছে এবারের বিপিএলে। টুর্নামেন্টে টানা চার ফিফটি হাকিয়েছেন, প্রায় প্রটি ম্যাচেই চার-ছক্কার ফুলঝুড়ি ফুটিয়ে নজড় কেড়েছেন সবার।
তবে যদি আপনি ক্রিকেটে পাড় ভক্ত হন বা দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের খোজও রেখে থাকেন সেক্ষেত্রে আজকের ইনিংস আপনার জন্য খুব একটা নতুন নয়। কারণ এই হৃদয় বরাবরই ইনিংস বিল্ডআপ করতে পারেন দক্ষ হাতে, যেটা ওয়ানডেতে একজন মিডল অর্ডার ব্যাটারের সবচেয়ে বড় গুণ।
৫৫ বলে ফিফটি স্পর্শ করেন হৃদয়, যাকে বলে একদম আদর্শ ওয়ানডে ইনিংস। সবচেয়ে বড় কথা হৃদয় ডট বল খেলেন, সচল রাখেন স্কোরবোর্ডের চাকা। ফিফটির পর যেটা করেছেন সেটা অবশ্য গত বিপিএলে হারহামেশাই করেছেন। দ্রুত রানের গতি বাড়িয়েছেন, তাতে নিজের স্ট্রাইক রেট যেমন বেড়েছে তেমনি দলের বড় সংগ্রহের মঞ্চও প্রস্তুত হয়েছে।
তবে ওই যে শুরুতেই বললাম, সবার হৃদয় জেতার দিনে নিজের হৃদয় ভেঙেছেন তাউহিদ। গ্রাহাম হুমের উইকেটের উপরের বল মিড উইকেটে খেলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা ব্যাটকে ফাঁকি দিয়ে আঘাত করে স্টাম্পে। নাহ, সেটা শুধু স্টাম্পে আঘাত করেনি সেটা সবার হৃদয়েও করেছে।
বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট অভিষেকে এখন পর্যন্ত চারজন সেঞ্চুরি করেছেন। ওয়ানডে ফরম্যাটে সেই জায়গাটা এতদিন খালিই ছিল। সবাই আশায় বুক বেঁধেছিলেন, এবার হয়তো সেটাই পূর্ণ হতে চলেছে, কিন্তু মাত্র একটি বলের ব্যবধানে সেই আশা ভেঙে চূড়মাড় হয়ে গেলো।
৮৫ বলের ইনিংসে ৮টি চার মেরেছেন, ২টি ছয়ও। অভিষেক ইনিংসে এর চেয়ে ভালো আর কি-ইবা হতে পারতো। তবে এরপরও ওই আটটি রান যেন হৃদয়কে পোড়াবে আজীবন। ওই আট রান হলেই যে বাংলাদেশের হয়ে অভিষেকে প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ানের ইতিহাস গড়তে পারতেন তিনি।
হৃদয় আউট হওয়ার পর যেন দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছিল। মনে হচ্ছিল, এটা তো না দুঃস্বপ্নেও হতো পারতো। হয়তো অনেকেই মনে মনে গেয়েছেন, "এটা গল্প হলেও পারতো, পাতা একটা আধটা পড়তাম, খুব লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখতাম তাকে।"
তবে সেঞ্চুরি মিসের হতাশার দিনে অভিষেক ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেছেন হৃদয়। এতদিন যেটা ছিল নাসিরের দখলে, ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৩ রান করেছিলেন তিনি।
এছাড়া আরও এক জায়গায় উঠেছে হৃদয়ের নাম। ওয়ানডে অভিষেকে নার্ভাস নাইনটিজে আউট হওয়া ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান তিনি। তবে চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, সর্বশেষ ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামার ব্রুকস ৯৩ রানে, সেটাও ছিল আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে।
হৃদয় সম্পর্কে যারা জানান, তাদের নিশ্চয়ই তার ভূয়া অ্যাকাডেমির খপ্পরে পড়া ঘটনার কথা জানা আছে। মায়ের জমি বন্ধক রেখে অনুশীলন করার জন্য টাকা জমা দেওয়ার পর দেখলেন প্রতারিত হয়েছে। ওই মুহূর্তে চেয়েছিলেন ক্রিকেটটাই ছেড়ে দিবেন। তবে এটা বলতেই হবে, বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, সেদিন হৃদয় ক্রিকেট ছাড়েননি। নাহলে তো এত বড় রত্ন হাতছাড়া হয়ে যেত দেশের।