চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ডের একটি বিখ্যাত গান, ‘এভাবেও ফিরে আসা যায়’ সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সত্যি বলতে সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় না বলে বেশ ব্যবহৃত হয়ে উঠেছে বললেই বোধহয় ঠিকঠাক হয়। অবশ্য এখানে গানের সাথে ক্রিকেট মেলানোতে বোধহয় একটু খটকা লাগছে।
না, খুব বেশি জটিল করবো না। লিটন কুমার দাস ও নাজমুল হোসেন শান্ত, তর্কসাপেক্ষে বাংলাদেশ ক্রিকেটে ট্রলের শিকার হওয়ার ক্রিকেটারদের তালিকায় উপরের দিকেই থাকবেন। ২০২১ সালে লিটন দাসকে নিয়ে অনলাইন শপগুলোর ‘ডিসকাউন্ট’ দেওয়ার ঘটনা এখনও মাঝে মাঝে উঠে আসে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
এরপর ২০২২ সালে ব্যাট হাতে লিটন রীতিমতো রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন, তিন ফরম্যাটে বছর জুড়ে দেখিয়েছেন তার সামর্থ্য। লিটনের ব্যর্থতা ও সফলতা মিলিয়ে কোলাজ বানিয়ে এভাবেও ফিরে আসা গান ব্যাকগ্রাউন্ডে দিয়ে বানানো হয়েছে হাজার হাজার ভিভিও এবং সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়াতে বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছে।
লিটনের কথা আজকে এটুকুই থাক, আজ নাজমুল হোসেন শান্তর জন্য কিছু শব্দ খরচ করা যাক। ট্রলের পাল্লা মাপলে শান্ত লিটনের চেয়ে কিন্তু খুব একটা পিছনে থাকবে না।
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। চট্টগ্রামে সেদিন বিপিএলে এক ম্যাচে মিড উইকেটে পুরো শরীর ঝাপিয়ে পড়ে দুর্দান্ত একটা ক্যাচ নিয়েছিলেন শান্ত। এরপরের দৃশ্য কি হওয়া উচিত? দর্শকদের অভিবাদন বা তাদের চোখেমুখে মুগ্ধতা। অথচ সেদিন আমি নিজে দেখেছি, এসবের কিছুই ছিল না। বরং কেউ কেউ তো বলছিল, ‘লর্ড’ ক্যাচও ধরতে পারে!
এছাড়া গ্যালারির বাকি অংশে প্রায় সবসময় শান্তকে লর্ড বলে ডাকাটা যেন বন্ধই হচ্ছিল না। অথচ এবারের বিপিএলে পুরো আসর জুড়েই হেসেছে শান্তর ব্যাট, হয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরাসহ সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক।
এখানে একটু জানিয়ে রাখি, লর্ড ব্রিটিশদের প্রদত্ত একটা উপাধি। জমিদারগণও লর্ড নামে পরিচিত ছিল। লর্ডের অনেক অর্থ আছে- রাজা, অধিপতি, শাসক ইত্যাদি। একজন খেলোয়াড় যখন ধারাবাহিক খারাপ করে তখন তাঁকে বাজে ফর্মের রাজা-জমিদার বলে ট্রল করেন সমর্থকেরা।
বিপিএলের মাঝেই শান্ত একদিন বলে বসলেন, মাঝেমাঝে তার নাকি মনে হয় দেশের পক্ষে নয় বিরুদ্ধে খেলতে নামেন! সব বাদ দেন, এই লাইনটুকু একটু গভীরভাবে অনুধাবন করেন। ক্রিকেটার স্বত্তা বাদ দিলেও একজন মানুষ হিসেবে এই লাইনটা ঠিক কখন বের হয়ে আসে মুখ থেকে!
শান্তকে আমি সবসময় কিউরিয়াস কেস অফ ক্রিকেট বলি। কয়েকজনকে বেশ কয়েকবারই বলেছি, এই ছেলেকে নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। যে ক্রিকেটারের প্রতিভার অভাব নেই, নেটে তাকে দেখলে যে কোনো কোচ মুগ্ধ হয়। সেই ছেলে কেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলতে পারছে না!
বয়সভিত্তিক থেকে ঘরোয়া ক্রিকেট, যখন যেখানেই খেলেছেন নিজেকে চিনিয়েছেন আলাদা করে। স্থানীয় কোচ থেকে শুরু করে জাতীয় দলের বিদেশি কোচ সবার অধীনেই হয়ে উঠেছেন তার প্রিয় মুখ।
শান্ত অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ খেলার পর থেকেই জাতীয় দলের সঙ্গে, তাকে নিউজিল্যান্ড নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আন্তর্জাতিক আবহের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। পুরো দেশ শান্তকে না চাইলেও টিম ম্যানেজমেন্ট তার উপর ভরসা করেছিল।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সেরা খেলোয়াড়দের প্রথমদিকে পরিসংখ্যানে এখন আর কেউ চোখ বোলায় না। অথচ তাদের থেকে শান্তর পরিসংখ্যান কখনোই খারাপ ছিল না। একদিন গল্পের ছলে এক সিনিয়র ক্রিকেটার বলছিলেন, ভাগ্য ভালো আমাদের সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া এতটা এক্টিভ ছিল না! আসলেই ভাগ্য ভালো না হলে শান্তদের মতো কতজনের রোষানলে পড়তে হতো প্রতিদিন সেটা আর নাই বললাম।
শান্তর এমন একটা অবস্থা, রান করলেও ট্রল না করলেও ট্রল। মানে শান্ত যেটা করতে সেটা নিয়ে যেন ট্রল করাটা একটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ট্রল,সমালোচনা খুব একটা ভালো থাকতে দেয়নি শান্তর মানসিক অবস্থাকে। তবে শান্ত কখনোই কাউকে আক্রমণ করে কিছু বলেননি। শুধু একবার বলেছিলেন ট্রল করলে পরিবারের সদস্যের খারাপ লাগে, তারা কষ্ট পায়।
শান্ত মুখে হয়তো কিছু বলেননি, তবে বলার জন্য বেঁছে নিয়েছেন তার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ব্যাটকে। যার শুরু সেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। অথচ দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রান করেও সেখানে ট্রল হয়েছেন তিনি।
এরপর ভারত সিরিজ, বিপিএলের পর ইংল্যান্ড সিরিজে যেন দেখা মিলেছে পরিণত, আত্মবিশ্বাসী এক অন্য শান্তর। এবার যেন পণ করেছেন যেভাবেই হোক তার প্রতি ম্যানেজমেন্টের অগাধ আস্থার প্রতিদান ব্যাট দিয়ে দিয়েই দিতে হবে।
প্রথম ওয়ানডেতে করলেন ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি, সেদিনও অবশ্য ট্রল হয়নি এমন নয়। নিন্দুকেরা বলেছেন স্ট্রাইক রেট নিয়ে। সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতে আবারও তার ব্যাট থেকে ফিফটি, অথচ সেখানেও স্ট্রাইক রেট নিয়ে কথা।
রানের জবাব দিয়েছেন ওয়ানডেতে আর স্ট্রাইক রেটের জবাব যেন দেওয়ার জন্য বেঁছে নিলেন টি-টোয়েন্টিকে। ইংল্যান্ডের দেওয়া ১৫৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাটিং করতে নেমে ৪৩ রানেই দুই উইকেট হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ।
এরপর কিছুটা চাপে পড়ার কথা বাংলাদেশের, অথচ শান্ত চাপ তো দূরের কথা ওই পজিশনেই খেললেন ৩০ বলে ৫১ রানের ইনিংস। আর দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ১১৭ রানের লক্ষ্য যখন বাংলাদেশের জন্য পাহাড় সমান হয়ে দাড়ালো তখন শান্তর ব্যাট যেন হয়ে উঠলো চীনের প্রাচীর।
৪৭টা বল খেলেছেন, এক প্রান্ত আগলে রেখেছেন, প্রয়োজন অনুযায়ী হাঁকিয়েছেন বাউন্ডারি! এক ইনিংসকে আর কতভাবে পরিচয় দেওয়া যায়। যেখানে অন্যরা আসছেন আর যাচ্ছে সেখানে শান্ত একাই দাঁড়িয়ে আছেন আশার প্রদীপ হয়ে। শেষ পর্যন্ত সেটা কিন্তু নিভতে দেননি, বরং জ্বলেছে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত।
ম্যাচ শেষে একাধিক দর্শককে দেখা গেছে গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে, শান্তর কাছে সরি বলতে। অনেকে তো শাহবাগে শান্তর কাছে গণক্ষমার আয়োজনও করতে চেয়েছেন। এগুলো সবই মজা করেও বললেও, এটা ঠিক অনেকেই কিন্তু এখন ভিতরে ভিতরে লজ্জ্বিত। শান্ত কিন্তু ঠিক জবাব দিয়েছেন, তবে তার সাথে এটাও দেখিয়েছেন, জবাব দিতে মুখ নয় ব্যাটই সবচেয়ে কার্যকরী অস্ত্র।
শেষে একটা কথা বলতেই হবে, বাংলাদেশ ক্রিকেটে নাজমুল হোসেন শান্ত বা লিটন কুমার দাস হওয়ার খুব একটা সহজ নয়। তাদের শুধু মাঠে ভালো খেললেই হয় না মাঠের বাইরের নোংরা ট্রলগুলোও হজম করতে হয়।
"ফিকে হয়ে আসা অন্ধকার, প্লাটফর্মে ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড় । জানলার কাঁচটাতে লেগে থাকা শূন্যতা, সশব্দে ছুটে চলে ট্রেনলতে পারিনি তার যেটুকু যা ভাষা ছিল, কেঁপে ওঠা চোখের পাতায়। তারপর ভোরবেলা ডিঙিয়েছি চৌকাঠ, ভয়ানক সতর্কতায়। এভাবেও ফিরে আসা যায়, এভাবেও ফিরে আসা যায়"- চন্দ্রবিন্দুর এই গানটা বোধহয় শান্তর ইদানিং খুব প্রিয় হয়ে উঠছে। না হলেও সমস্যা নেই, তিনি যা করছেন মাঠে ভক্তরাই তাকে এই গান এবার মুখস্ত করিয়ে ছাড়বে।