দাদার ‘সৌরভে’ বিমোহিত হওয়া এক বিকেল

সৌরভ কুমার দাস প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৩, ১০:৪২ পিএম

তার আসার কথা ছিল বেলা তিনটা নাগাদ, কিন্তু ঘড়ির কাটায় তিনটা পার হলেও তার দেখা নেই। ওদিকে তাকে ছাড়া তো অনুষ্ঠানও শুরু হচ্ছে না। সৌরভ গাঙ্গুলি জন্মেছেন ভারতে, খেলেছেন সে দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলে। কিন্তু জাতিসত্তায় পুরোপুরো বাঙালি সৌরভ তার নিজের জন্মভূমি ভারতের চেয়ে পাশ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশেও কম জনপ্রিয় নন।

সেটাই যেন আরও একবার দেখা গেল ঢাকার দ্য ওয়েস্টিন হোটেলের বলরুমে। সৌরভের অপেক্ষায় অনুষ্ঠান শুরুর অন্তত ঘণ্টা দেড়ে আগেই সাংবাদিকের ভিড়ে যেন পা ফেলার জায়গাই ছিল না সেখানে। এর মধ্যে আয়োজক ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তার মুখে শোনা গেল, ফ্লাইট ডিলে হওয়ায় সৌরভের আসতে দেরী হবে।

সৌরভের আসার ফাঁকে আরেকটা বিষয় বলে দেই। আজকের বলরুমে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের বাইরে কাউকে সৌরভকে তার নামে ডাকতে শোনা যায়নি, যদি ভুল না করি বা ভুলে না যাই তাহলে এটাই সঠিক। তাকে সবাই ডেকেছেন দাদা বলে, যেটা সেই ক্যারিয়ারের প্রায় শুরুর দিক থেকে তার নাম হয়ে গিয়েছে। ওপার বাংলার মতো এপার বাংলার লোকও আজ তাকে নিজের নাম নয় দাদা বলেই ডেকে গেল সারাক্ষণ।

বিকাল পৌনে চারটায় সৌরভকে ওহ, না দাদাকে বহনকারি গাড়ি এসে পৌছালো হোটেল ওয়েস্টিনে। দাদা পৌঁছানো মাত্র অন্তত শ‍‍`খানেক ক্যামেরার লেন্স ঘিরে ধরলো তাকে। তাকে নির্বিঘ্নে হাঁটার সুবিধা করে দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছিলেন নিরাপত্তাকর্মীরা। অথচ এই লোকটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন ১৫ বছর আগে, স্বীকৃত পর্যায়ে শেষবার খেলেছেন এক দশক আগে। 

প্রথমে ভিতরে ঢুকে ইভেন্ট কোম্পানির লোক আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে মিনিট পাঁচেক প্রাথমিক আলাপ সেরে নিলেন দাদা। মূলত সেখানে দাদাকে অনুষ্ঠানের রোডম্যাপটাই ব্রিফ করছিলেন তারা।

এরপর লিফটে করে উঠলেন বলরুমে। লিফটে ওঠা থেকে শুরু করে মঞ্চের ঠিক সামনে নিজের আসনে গিয়ে বসার আগ পর্যন্ত তাকে ঘিরে ছিলেন সাংবাদিকরা আর তাদের ক্যামেরার লেঞ্চ। সাংবাদিকদের ভিড় সামলে সৌরভকে এগিয়ে নিতে রীতিমতো মানব দেওয়াল বানাতে হয়েছিল নিরাপত্তাকর্মীদের। তবে সেখানে নিরাপত্তাকর্মীরা হিমশিম খেলেও সৌরভের মুখে কখনোই এতটুকু বিরক্তির ছাপ দেখা যায়নি।

সৌরভের আগমনে আর দ্রুত শুরু হয় অনুষ্ঠান। শুরুতেই এলইডি লাইট নিয়ে বাংলাদেশি কয়েকজন তরুণ তরুনী নৃত্য পরিবেশন করলেন। এরপর চিত্রনায়িকা দিঘীর নৃত্যে জমে ওঠে ওয়েস্টিনের পুরো বলরুম।

নৃত্যের পর্ব শেষে এক পর্যায়ে সৌরভকে নিয়ে বানানো একটি প্রামান্যচিত্র দেখানো হয় বড় পর্দায়। যেখানে সৌরভের ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখানো হয়।

অনুষ্ঠানে একাধিক বক্তা বক্তব্য দেন। সেখানে সবার বক্তব্যের সারাংশ করলে ‘সৌরভ’ ছাড়া আর কিছু খুঁজে পাওয়া দুস্কর! ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম তার ব্যক্তব্যে তো সৌরভ ছাড়া আর কিছু খুজেই পাচ্ছিলেন না।

নিজের প্রতি বাংলাদেশিদের এত মুগ্ধতা, মেয়র আতিকের এত প্রশংসা সৌরভ শুনছিলেন মঞ্চের একদম সামনের সারিতে বসে। ওই সময় তার মুখে ছিল স্বভাবজাত মিষ্টি হাসি,  যে হাসিতে মুগ্ধ হয় যে কেউ।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ক্রিকেট-ফুটবলেরও যেন তারার হাঁট মিলেছিল। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, রকিবুল ইসলাম, ধারাভাষ্যকার আতহার আলী খান, সাবেক ফুটবল কায়সার হামিদও।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে বক্তব্য দিতে ওঠেন সৌরভ। তার আগে অবশ্য টুর্নামেন্টের উদ্বোধন ও জার্সি উন্মোচন করেন  ভারতের এই সাবেক অধিনায়ক।

নিজের বক্তব্যের শুরুতেই বাংলাদেশি মানুষদের ভালোবাসার কথা বলেন সৌরভ। সেটার পরিমাণ এতটা যে, এদেশের আসলে ভারতের সঙ্গে নাকি পার্থকই খুঁজে পান না।

দাদা বলেন, “যতবারই আমি এখানে আসি, এত মানুষের ভালোবাসা পাই আমি বুঝতে পারি না এটা ভারত না বাংলাদেশ। আমাকে এত ভালোবাসা, এত নিজের মনে করার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা। মেয়র কাপ যেটি দ্বিতীয় সিজনের উদ্বোধন হলো, এটি কিন্তু পশ্চিম বাংলাতেও হয়।”

বাংলাদেশে প্রথম কবে এসেছিলেন সৌরভ? এই প্রশ্নের উত্তর যদি না পারেন তাহলে নিজেকে দোষ দেওয়ার  কিছু নেই। সৌরভ নিজেই গুলিয়ে ফেলেছিলেন কবে প্রথম এ দেশে এসেছিলেন। প্রথমে বললেন, ১৯৮৯ পরে আবার বললেন ১৯৮৭। এরপর সামনে থেকে দীর্ঘদিনের বন্ধু ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পরিচালক ইফতেখার মিঠু মনে করিয়ে দিলেন, ১৯৮৯-ই হবে।

“বাংলাদেশে আমি প্রথম আসি ১৯৮৯ সালে। আমি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে এশিয়া কাপ খেলতে। না, ১৯৮৭ হবে হয়তো সেই থেকে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। না না, ওই যে হ্যাঁ, ১৯৮৭ হবে (মিঠু বলার পর)। এখানে প্রচুর মানুষ বন্ধু আমার। ইফতেখার রহমান মিঠু (বিসিবি পরিচালক) সেই থেকে আমার বন্ধু। হয়ত গেল দশ বছর আমি আসিনি। কিন্তু তার সাথে তার পরিবারের সাথে বাকি বন্ধুদের সাথে আমার দেখা হতো পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়” যোগ করেন সৌরভ।

২০০১ সালে প্রথম টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ। কাকতালীয়ভাবে সৌরভের অধিনায়ক হিসেবে ওটাই ছিল প্রথম টেস্ট। সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে লিড নেওয়া ভারত যে মনে ভয় ধরিয়েছিল সেটাও জানিয়েছেন সৌরভ।  

সৌরভ বলেন, “আমার প্রথম টেস্ট অধিনায়কত্ব বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে থাকবে। কারণ ওটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচ। আমার মনে আছে তখন নতুন স্টেডিয়াম হয়নি, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ সম্ভবত প্রথম ইনিংসে লিড নিয়েছিল। ড্রেসিংরুমে গিয়ে ভাবলাম, জীবনের প্রথম টেস্ট নেতৃত্বে হেরে যাব! পরে আমরা ম্যাচে ফিরে আসি এবং জিতি। আমার জীবনের বহু মূল্যবান মুহুর্ত বাংলাদেশে।”

মূলত মাদকমুক্ত শহর গড়ার লক্ষ্যে মেয়র কাপ আয়োজন করেছে ডিএনসিসি। সেটার কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাও ওঠে আসলো সৌরভের কণ্ঠে।

“বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে চেষ্টা করছে সেটা সত্যিই প্রয়োজনীয়। সারা বিশ্বেই এই ক্যাম্পেইন দেখেছি। কারণ ড্রাগস কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের কাছে একটি আতঙ্কের কারণ। আমি মাননীয় মেয়র সাহেবকে ধন্যবাদ জানাই। উনি খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের যুব সমাজকে ব্যস্ত রেখেছেন। আমি মনে করি মাদকের সমাধান একমাত্র স্পোর্টস। বাংলাদশের সংস্কৃতি সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। মিউজিক হলো বাংলাদেশের মানুষের হার্টবিট।”

বাংলাদেশে সবখানে উন্নয়নের ছোয়া দেখেছেন সৌরভ। যুব সমাজকে এই উন্নয়নের অংশ হতে বলেন দাদা।

দাদা বলেন, “আমি সবার কাছে অনুরোধ করবো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ও মাঝবয়সীদের, মাদক জীবনের সমাধান নয়। কঠোর পরিশ্রমই একমাত্র সমাধান। তাই খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত থাকো, গান-বাজনার সঙ্গে যুক্ত থাকো, শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকো। এগুলো তোমাদের এগিয়ে যেতে সাহাজ্য করবে। যতবার ঢাকা আসি, এই শহরের মধ্যে দিয়ে যখন আসি আমি প্রচুর পরিবর্তন দেখতে পাই। আমি ৯ বছর পর এসে দেখি রাস্তা কত চওড়া হয়েছে, বিভিন্ন ফ্লাইওভার হয়েছে। গুলশান দিয়ে যখন এলাম দেখলাম এখানেও কত পরিবর্তন এসেছে। এই উন্নয়ন কাদের জন্য? যুব সমাজের জন্য। তাই এই উন্নয়নের সঙ্গে তোমরা এগোও, উন্নয়নের অংশ হও।”

বক্তব্য শেষে বাঁধল বড় সমস্যা, সৌরভকে বের করে নিয়ে যাওয়াটা যেন নিরাপত্তাকর্মীদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ালো। শতাধিক ক্যামেরা ও বুমকে টপকে বহু বাঁধা পেরিয়ে সৌরভকে বের করে নিয়ে গেলেন তারা। তবে যাওয়ার আগে হয়তো দাদা আরও একবার দেখলেন এদেশের মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসে, খেলা ছাড়ার দেড় দশক পরও জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একদমই।