ডি মারিয়া: দ্য ম্যান অব ফাইনালস

পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৯, ২০২২, ০১:৫৮ এএম

আর্জেন্টিনার ছোট্ট শহর রোজারিওর এক নিম্নবিত্ত পরিবার জন্ম এক সন্তানের। ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত দুরন্ত স্বভাবের সন্তানকে ঠিক করতে চিকিৎসকের শরণাপন্ন মা। চিকিৎসকের পরামর্শ ছেলেকে ফুটবল খেলতে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে বল কিনে দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় চিন্তায় পড়েন মা।

সেই সমস্যা সমাধানে কয়লা শ্রমিক হিসেবে কাজ করা শুরু। মাত্র ১০ বছর বয়সে কয়লাশ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করায় শিশু শ্রমিকের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়ালেন। তবুও বন্ধ হয়নি খেলা। শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করার পর টাকা জমিয়ে কিনেছিলেন ফুটবল। ওই ফুটবল দিয়েই খেলার শুরু।

আস্তে আস্তে রোজারিও নামের ওই ছোট্ট শহর থেকে পৌঁছে গেছেন ইউরোপে। সেখান থেকে বিশ্বকাপের মঞ্চে আর্জেন্টিনার জার্সিতে তুলে ধরেছেন বিশ্বকাপ শিরোপা। আর্জেন্টিনা যেই ফাইনালই জিতেছে, তার পা থেকে এসেছে গোল। তিনি আর কেউ নন। আর্জেন্টিনার বাম উইংয়ের ভরসার নাম অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। আর্জেন্টিনার দ্য বয় ফাইনালস। কারণ, আর্জেন্টিনার ফাইনাল জয় মানেই তো ডি মারিয়ার গোল।

আর্জেন্টিনার জার্সিতে বিশ্বকাপ পর্যন্ত চারটি ফাইনাল জয়ের স্বাদ পেয়েছেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। শুরুটা একযুগেরও বেশি সময় আগে ২০০৮ সালে। সেবার এই এশিয়াতেই আলবিসেলেস্তাদের জার্সিতে প্রথম শিরোপা জয়ের স্বাদ পান অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া-সার্জিও আগুয়েরো-লিওনেল মেসিরা।

বেইজিং অলিম্পিকে ডি মারিয়ার একমাত্র গোলে সোনার পদক পায় আলবিসেলস্তারা। ওই জয়ের পর আরও তিনবার আর্জেন্টিনার জার্সিতে ফাইনালে খেলার সুযোগ এসেছিল ডি মারিয়ার সামনে। প্রথমবার ছিল ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে ফাইনালে। উরুর চোট সেবার মাঠে নামতে দেয়নি। ফলে মাঠের বাইরে থেকেই তাকে দেখতে হয়েছে দলের হার।

পরেরবার ২০১৫ সালে কোপা আমেরিকায় দ্বিতীয়বার ফাইনাল খেলার সুযোগ মেলে ডি মারিয়ার। এবারও তার সঙ্গী হয় ইনজুরি। তবে সেটা মাঠে নামার পর। চিলির বিপক্ষে ওইদিনে ফাইনালের ২৯ মিনিটের সময় হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে উঠে যেতে বাধ্য হন। ওইদিনও তাকে মাঠের বাইরে বসে দেখতে হয়েছে দলের হার।

২০১৬ সালে ওই চিলির বিপক্ষে আরও একবার সঙ্গী হয়েছিল আর্জেন্টিনার হার। এবারও সাইডলাইনে বসে প্রতিপক্ষের জয় উদযাপণ দেখে নিজের মনের মধ্যে পুষে রাখছিলেন কষ্ট।

২০২১ সালে অবশ্য আর ভাঙেনি ডি মারিয়ার মন। কোপা আমেরিকায় হয়েছিল সুপার ক্ল্যাসিকো। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিপক্ষে তার একমাত্র গোলেই নিশ্চিত হয়েছিল শিরোপা।। দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে শিরোপা জিততে না পারার অপবাদ ঘুচেছিল আর্জেন্টিনার।

কোপা জেতার সুবাদে সুযোগ মেলে ফাইনালিসিমা খেলার। ইউরোপ-ল্যাতিন আমেরিকার সেরা কে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই এই ফাইনালিসিমা। কোপা জিতে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থাকা আর্জেন্টিনা এবার হারিয়ে দেয় ইউরো চ্যাম্পিয়ন ইতালিকে।

ইউরোপ-ল্যাতিন সেরা হওয়ার সময়ও ডি মারিয়ার পা থেকে এসেছে গোল। দলের জার্সিতে দ্বিতীয় গোলটা তারই। তিন শিরোপা জয়ে ডি মারিয়ার পায়ে এলো গোল। টানা তিনের ধারাবাহিকতায় বিশ্বকাপেও ছিল তার পায়ে একটি গোলের অপেক্ষা।

লুসাইলে আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স লড়াইয়ে দলের দ্বিতীয় গোলটা ওই অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার পায়ে। ফাইনালে তার গোলের পর কখনই হারেনি আর্জেন্টিনা। হয়েছেও তাই, বিশ্বসেরার মুকুট পড়েছে আর্জেন্টিনা, ওই আকাশী-নীল শিবির।

ডি মারিয়ার করা চার গোলে আছে অদ্ভুত দুইটি মিল। ফাইনালে করা তার চার গোলের প্রথম দুইটি ছিল ম্যাচের প্রথম ও একমাত্র গোল। পরের দুইটি ছিল ম্যাচের দ্বিতীয় গোল। অর্থাৎ, প্রথম দুই ফাইনাল আর্জেন্টিনা জিতেছিল অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার ওপর ভর করেই।

যেই রোজারিও শহর দিয়ে শুরুটা হয়েছিল, সেই রোজারিওতেও এখন ফুটবল উৎসব। বিশ্বকাপ জয়ে যে আছে শহরের ছেলের অবদান। অবশ্য অবদান বললে ভুল হবে, বলতে হবে সরাসরি ভূমিকা। অভিনন্দন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া! কয়লা খনি থেকে দ্য বয় অব ফাইনালস হওয়ার যাত্রাটা মোটেও সহজ ছিল না। বিশ্বকাপ তো জিতে নিয়েছেন, এবার না হয় একটু উপভোগ করেন।