‘সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব পাবে মেয়েদের পরিবার’

পার্থ প্রতীম রায় প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২২, ০২:০৭ পিএম

সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশ। শিরোপা জেতা মেয়েরা দেশে ফিরে পেয়েছেন ‘ছাদখোলা’ বাসে শিরোপা উদ্‌যাপনের স্বাদ। দিন কয়েক ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এই মেয়েরাই। তাদের সাফল্যে পেছনের মূল কারিগর কারা কিংবা তাদের উঠে আসার পথ কতটা বন্ধুর ছিল, তা নিয়ে আলোচনা বেশ নগণ্যই।

মেয়েদের সাফল্যের পথে থাকা বাধাগুলো উতরাতে পরিবারই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব প্রাপ্য বলে মনে করেন দেশের একমাত্র নারী ক্রিকেট একাডেমির কোচ আরিফা জাহান বীথি। সংবাদ প্রকাশের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বীথি।

তিনি বলেন, “সব থেকে বেশি কৃতিত্ব দেব সেই মেয়েগুলোর (সাফ শিরোপাজয়ী দলের সদস্যরা) পরিবারকে। তাদের পরিবার যদি মানুষের কথা শুনে খেলাধুলা বন্ধ করে দিত, তাহলে এই মেয়েগুলো আর সমর্থন পেত না। মূল সমর্থনটা কিন্তু পরিবার। এত বাজে বাজে কথা শুনতে হয়, আপনারা যদি নিজ কানে শুনতেন… মাঝে মাঝে মনে হয়, খেলাধুলাটা না করলেই পারতাম। অন্য লাইফ লিড করতে পারতাম।”

নারী ফুটবল দলের সাফল্যে উদ্‌যাপনে শামিল হয়েছিলেন সব বয়সী নারী-পুরুষ। তারা সবাই শুরু থেকে নারী ফুটবলকে সমর্থন করেনি। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, নারী ফুটবলারদের অনুশীলন বন্ধে আন্দোলন করছেন। তা নিয়েও দেখা যায়নি প্রতিবাদ।

বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ ঝরেছে আরিফা জাহান বীথিত কণ্ঠে। তিনি বলেন, “আমরা যারা এই জয়টা উদযাপন করছি সেই মানুষগুলো কিন্তু শুরু থেকে সমর্থন করেনি। সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, কিছু ধর্মভীরু মানুষরা রাস্তায় মিছিল করেছে, যাতে মেয়েদের অনুশীলন বন্ধ হয়, মেয়েরা যেন খেলাধুলায় না আসে। দেখেন ভিডিওটা যখন প্রচার হয়, তখন আমরা যারা উৎসাহ দিচ্ছি তারা কিন্তু প্রতিবাদ করে নাই।”

সম্প্রতি মেয়েদের পোশাক নিয়ে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। সেই বিতর্ক আরও উসকে দেয় পক্ষে-বিপক্ষের নানা সমালোচনা। খেলার মাঠে পোশাকের এই বিতর্ক নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। বিষয়টি মেয়ে অ্যাথলেটদের উঠে আসার পথে একটি বাধা হিসেবেও চিহ্নিত করেছেন আরিফা জাহান বীথি।

তিনি বলেন, “আমাদের একটা খেলোয়াড়ের পোশাক নিয়ে অনেক সমস্যা। ক্রিকেটাররা ফুল প্যান্ট পরে খেললেও কিন্তু ফুটবলাররা হাফ প্যান্ট পরে খেলে। তাদের সামনে অনেক বেশি বাধা। একটু ভেবে দেখেন, সেই মেয়েগুলোর ওপর দিয়ে কত কিছু চলেছে, কত কথা শুনতে হয়েছে।”

খেলার মাঠে বড় মঞ্চে সাফল্য পেতে হলে সবচেয়ে বড় কাজটা করতে হয় কোচদের। বিশেষ করে তৃণমূল থেকে খেলোয়াড়দের তুলে আনার কাজটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নারী খেলোয়াড়দের সেখান থেকে তুলে আনার কাজটি করা বেশ কঠিন।

এই নিয়ে আরিফা জাহানা বীথি বলেন, “এমন অনেক হয়েছে, একটা মেয়েকে নিয়ে এসে ছয় মাস ট্রেনিং করানোর পর দেখা গেছে, ওই মেয়ে আর আসে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাকে তার পরিবার খেলতে দেবে না। কারণ, চারপাশের মানুষ নানা কথা শোনায়। মানুষের চাপে পড়ে খেলা বন্ধ করে দেয়।”

তৃণমূল থেকে মেয়েদের তুলে আনতে কোচদের শুনতে হয় নানা কটুকথা। সাফ শিরোপাজয়ী কোচ গোলাম রব্বানি ছোটন জানিয়েছিলেন, কী রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। বিষয়টি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আমাদের সমাজ এখনো মেয়েদের অ্যাথলেট হিসেবে মেনে নিতে সক্ষম নয়।

দেশের একমাত্র নারী ক্রিকেট একাডেমির কোচ আরিফা জাহান এই নিয়ে বলেন, “আপনি দেখেন গোলাম রব্বানি স্যার তার ইন্টারভিউতে বলেছে, তার বন্ধুবান্ধবরা তাকে নানা কথা শুনিয়েছে। তার মধ্যে তিনি আবার পুরুষ কোচ। ওনার বন্ধু বান্ধবরা তাকে নানা বাজে বাজে কথা বলেছে। কিন্তু সেই মানুষটাই জানে, এই মেয়েগুলোকে কীভাবে ধরে রেখেছে। তার অবদানকেই আমি বড় করে দেখব।”

সাফল্যের ভারে সাম্প্রতিক সময়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েদের খেলাধুলা। বড় বড় সাফল্য এনে দেওয়ার পরও সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক, সব জায়গায় পিছিয়ে এই নারীরাই। এর পেছনে অবশ্য ফেডারেশনের দায়ভারই দেখেন আরিফা জাহানা বীথি।

বীথি বলেন, “ফেডারেশন যদি মেয়েদের খেলার প্রতি আরও বেশি নজর দিত। তাদের সুযোগ-সুবিধা আরও বেশি করত, তাহলে মানুষ আরও বেশি জানতে পারত।”

তার কণ্ঠে আফসোস ঝরেছে নারীদের খেলাধুলায় গণমাধ্যম আগ্রহ না দেখানোয়। তবে এর পেছনে অবশ্য তিনি দায় দেখছেন স্পনসরদের আগ্রহের। বীথির আহ্বান, মেয়েদের খেলাধুলায় এগিয়ে আসবে বড় বড় প্রতিষ্ঠান ও মানুষরা। তাহলেই অতিক্রম করা যাবে মেয়েদের খেলতে আসার বাধা।

তিনি বলেন, “আমরা সব সময় বলি, নারী আর পুরুষের সমান অধিকার। কিন্তু দেখেন আমাদের প্রেক্ষাপটে দেখেন তা হচ্ছে না। মিডিয়া যদি নারী ক্রিকেট বা ফুটবলকে সাপোর্ট করত…। কোনো চ্যানেল যদি স্পনসরশিপ না পায় তাহলে কিন্তু মেয়েদের খেলাগুলো দেখাতে পারবে না। এখানে বড় বড় কোম্পানি বা মানুষরা যদি এগিয়ে আসে তাহলে হয়তো এই অর্জন আরও বেশি হাইলাইট হতে পারত। বেশি জানত পারত।”