মেয়েরা পর্দা করবে, সংসার করবে, ঘর সামলাবে। মেয়েরা কেন ঘরের বাহিরে থাকবে? আমাদের সমাজে মেয়েদের এভাবেই দেখা হয়। কিন্তু সবকিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। এ প্রমাণ আমাদের দেশের নারী ফুটবলাররা। দেশের নারীদের এই অগ্রযাত্রায় জায়গা করে নিয়েছেন টাঙ্গাইলের মেয়েরা। সমাজের বিভিন্ন পেশার ন্যায় খেলাধুলাতেও তারা নিজেদের তুলছেন নতুন উচ্চতায়। এতে দেশ ছাড়াও সারা বিশ্বে জায়গা করে নিয়েছেন। তাদের একজন বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল ও সাফ জয়ী দলের ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় কৃষ্ণা রানী সরকার (২২)।
সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতে সারা দেশের মানুষ এখন আনন্দে ভাসছে। ফাইনালে নেপালের মাটিতে স্বাগতিকদের হারিয়ে বাংলাদেশের মেয়েদের এ সাফল্য খুলে দিয়েছে ফুটবলের নতুন দুয়ার। তিন গোলের মধ্যে দুটি করেছেন কৃষ্ণা রানী সরকার।
সেই আনন্দ ছুঁয়ে গেছে কৃষ্ণার বাড়িতে। টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া গ্রামে। তবে, বাড়িতে বিদ্যুৎ না থাকায় তার মা নমিতা রানী সরকার মেয়ের খেলা দেখতে পারেননি। বাবা খেলা দেখেছেন অন্য গ্রামে গিয়ে। আর ভাই পলাশ সারা দিন উপবাস করেছিলেন বোনের ভালো খেলার জন্য।
মঙ্গলবার (২০ সেপ্টেম্বর) সরেজমিনে কৃষ্ণা রানী সরকারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের অনেকেই তাদের বাড়িতে এসেছেন। সবাই কৃষ্ণার উচ্চসিত প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পাড়ার মানুষ আনন্দিত। অভিনন্দন জানাচ্ছেন তার বাবা-মাকে।
বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার আগে দর্জির কাজ করতেন। এখন কৃষ্ণার দেওয়া টাকা দিয়ে কিছু জমি কিনে চাষবাস করছেন। বাড়িতে আগে ছোট একটি টিনের ঘর ছিল। এখন একতলা বিল্ডিং হয়েছে। একমাত্র ছোট ভাই পলাশ চন্দ্র সরকার ঢাকার গ্রীন ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্র।
স্থানীয় এলাকাবাসীরা জানান, একসময় কৃষ্ণা রানীর পরিবার অনেক কষ্ট করে চলত। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে আর্থিক অনটন। যে কজন নারী ফুটবলার আছেন তাদের বেশিরভাগই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। খেলার ছলে ফুটবল খেলেছেন তারা।
প্রাথমিক স্কুলভিত্তিক ফুটবল থেকে আসা এই মেয়েরা এখন স্কুলে সারা বছরই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। খেলছেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অনুষ্ঠিত হওয়া টুর্নামেন্টগুলোতে। প্রধানমন্ত্রী যদি তার মায়ের নামে প্রাইমারি স্কুল পর্যায়ে ফুটবল শুরু না করতেন তাহলে তারা এ পর্যন্ত আসতে পারতেন না। তারা জানতেন না ফুটবল খেললে টাকা পাওয়া যায়, বিদেশে যাওয়া যায়। এখন তারা বোঝেন ফুটবলের কত মূল্য। পরিবারের নানা প্রতিকুলতাকে দূরে ঠেলে তারা ফুটবল খেলছেন।
প্রত্যন্ত উপজেলা পর্যায়ে নারীদের এমন ফুটবল প্রশিক্ষণ চালিয়ে যাওয়া অনেক কষ্টকর। নানা কষ্টের মধ্যে নারী ফুটবলাররা অনেক সফলতা বয়ে আনছেন। কৃষ্ণা রানীর পরিবারের সফলতার পাশাপাশি তার গ্রামের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।
প্রতিবেশী বিউটি রানী সরকার বলেন, “আমাদের সামনেই বড় হয়েছে কৃষ্ণা। ফুটবলের প্রতি খুব আগ্রহ ছিল। মনের ভেতর অনেক জেদ ছিল। কারও কটু কথা কোনোদিন পাত্তা দিত না। তার এই সাফল্যে আমরা খুব খুশি।”
কৃষ্ণা রানী সরকারের ছোট ভাই পলাশ চন্দ্র সরকার বলেন, “দিদির (বোন) খেলার জন্য সারা দিন উপবাসের ব্রত করেছিলাম। জয়ের পর দিদির সঙ্গে কথা বলে তারপর খেয়েছি। দিদিও টেনশনে ছিল। আমি তাকে সকালে বলেছি, ‘তুমি টেনশন না করে ভগবানের নাম নিয়ে তোমার সেরা খেলাটা খেলার চেষ্টা করো।’ এদিকে আমরাও উদ্বিগ্ন ছিলাম ফাইনাল নিয়ে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি যেন আমার দেশ এই শিরোপা জিতে। আর আমার দিদি যেন ভালো খেলতে পারে। ঈশ্বর আমার দুটি কথাই রেখেছেন। এই আনন্দ কাউকে বলে বোঝাতে পারব না।”
কৃষ্ণার মা নমিতা রানী সরকার আফসোস করে বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকায় খেলা দেখতে পারিনি। খেলা শেষ হওয়ার পর প্রতিবেশীরা বাড়িতে এসে জয়ের কথা জানায়। আমার ছেলেও মোবাইল ফোনে বলেছে। আমি কৃষ্ণাসহ ওদের দলের সবার জন্য দেশবাসীর কাছে আশীর্বাদ চাই।”
কৃষ্ণা রানীর মা বলেন, “আমার মেয়ে যখন নতুন নতুন খেলতে যেত, তখন আমাদের অনেক কটুকথা সহ্য করতে হয়েছে। তবে এখন মেয়ের সাফল্যে ভালো লাগে। যারা একসময় সমালোচনা করত তারাই এখন প্রশংসা করে। সমাজ বদলাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনোভাবও। ক্রীড়া ক্ষেত্রে মেয়েদের সাফল্যও মানুষ ভীষণ উপভোগ করে এখন।”
কৃষ্ণা সরকারের বাবা বাসুদেব চন্দ্র সরকার বলেন, “বিদ্যুৎ না থাকায় আমি পাশের গ্রামে গিয়ে খেলা দেখে দারুণ খুশি। মেয়ের খেলায় খুব খুশি। এলাকার মানুষও খুব উপভোগ করেছে। অনেকেই আনন্দে শুভেচ্ছা জানাতে আসছেন। কৃষ্ণা যেন দেশের জন্য আরও গৌরব বয়ে আনে সেই আশীর্বাদ চাই।”
সম্ভাবনায় তরুণ ফুটবল খেলোয়াড়দের জেগে তোলার পেছনে কিংবা সম্ভাবনায় তরুণ ফুটবলার তৈরির পেছনে একজন ভালো মানের ফুটবল কোচ প্রয়োজন। একজন দক্ষ কোচ তার নিবিড় প্রশিক্ষণ ও কৌশলের মাধ্যমেই তরুণ ফুটবলারদের উৎসাহ দিয়ে শতভাগ খেলা আদায় করে।
এক সময়ের টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার তারকা ফুটবলার স্টাইকার বাপনের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। জাতীয় নারী ফুটবল দলের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটনের পরামর্শে ফুটবল কোচ হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। তিনি ফুটবলে ছেলে ও নারী উভয়েই প্রশিক্ষণ দেন। দীর্ঘ ২২ বছর যাবত তিনি ওই স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক। কোচ হিসেবে তার বড় সাফল্য ২০২০ সালে টাঙ্গাইল বালিকা (অনুর্ধ্ব-১৪) ফুটবল দল নিয়ে।
গত ২০০৬ সালে মাত্র ১৮ জন নারী নিয়ে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলায় ফরহাদ হোসেন স্মৃতি ফুটবল একাডেমির পথ চলা শুরু হয়। বর্তমানে এই একাডেমিতে ২৫ জন নারী ফুটবলার প্রতিদিন উপজেলার সূতী ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সকাল-বিকাল প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বর্তমানে এই একাডেমিতে কৃষ্ণা রানী সরকার, ইতি, নিতি ও মাহফুজাসহ ৭ নারী ফুটবলার জাতীয় দলে খেলছেন।
গোপালপুর সূতী ভিএম পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক গোলাম রায়হান বাপন বলেন, “কৃষ্ণার খেলায় নৈপুণ্যতা রয়েছে। রয়েছে তীব্র আকাঙ্খা। বল নিয়ে দৌড়ানোর তীব্র গতি। আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম ও ভালো কিছু করবে। কৃষ্ণার সাফল্যে আমরা তথা টাঙ্গাইলবাসী গর্বিত।”
আরও বলেন, “সমাজ বদলাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনোভাবও। এখন ক্রীড়াক্ষেত্রে মেয়েদের সাফল্যও মানুষ ভীষণ উপভোগ করে। তাই গোপালপুর তথা সারা বাংলাদেশের মেয়েদের কাছে কৃষ্ণা এখন অনুপ্রেরণা ও আইডল।”
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ মল্লিক কৃষ্ণা রানী সরকারকে সংবর্ধনা দেওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, “কৃষ্ণা শুধু গোপালপুর কিংবা টাঙ্গাইল জেলার মেয়ে নয়, সারা দেশের গর্ব। বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টের মাধ্যমে তার উত্থান শুরু। দেশে ফেরার পর আমরা কৃষ্ণাকে নিয়ে বড় করে একটি সংবর্ধনা দেব। কৃষ্ণা মাকে কিছুদিন আগে রত্নগর্ভা সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।”
টাঙ্গাইলের (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের সংসদ সদস্য তানভীর হাসান ছোট মনির বলেন, “কৃষ্ণা রানী সরকার দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। কৃষ্ণার অর্জনে আমরা পুরো দেশের মানুষ আজ গর্বিত। বিভিন্ন সময় ওকে আমরা সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি। আমাদের গ্রামের মেয়েরা খেলাধুলায় আসতে চায় না। কৃষ্ণা সেখানে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আজ জাতীয় তারকায় পরিণত হয়েছে। কৃষ্ণার সাফল্যকে সম্মান জানাই। গ্রামের মেয়েদের প্রতিভা বিকাশের জন্য সমাজের বিত্তবানসহ সবাইকে সংরক্ষণশীলতা ভেঙে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমাদের সুনাম বয়ে আনবে।”
সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে ৩-১ ব্যবধানে জিতে বাংলাদেশকে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা এনে দেন মেয়েরা। এতে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট পরে বাংলাদেশ ভাসছে আনন্দের জোয়ারে।