ক্রীড়া ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ও তার অবদান

মো. হাবিবুর রহমান প্রকাশিত: আগস্ট ১৪, ২০২১, ০২:৪২ পিএম

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনীতিতে তিনি যেমন ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী, খেলাধুলায়ও ছিলেন তেমনি। স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি তার পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। বংশানুক্রমিক ভাবে তিনি ছিলেন খেলা পাগল। কারণ তার বাবা শেখ লুৎফর রহমানও ছিলেন খেলা প্রিয় মানুষ। সেই সময়ে গোপালগঞ্জের প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টগুলোতে নিয়মিত খেলতেন বঙ্গবন্ধুর বাবা। গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাব দলটির অধিনায়ক ছিলেন তিনি। 

বঙ্গবন্ধুর প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। কিশোর বয়স থেকে ফুটবলে বেশ পারদর্শী হয়ে ওঠেন তিনি। বাবাকে খেলতে দেখেই মনে হয় ফুটবল খেলাটাকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই ফুটবলে হাতেখড়ি হয়ে যায় তার।

গোপালগঞ্জ অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন বঙ্গবন্ধুর বাবা। বাবার খেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিম যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভাল ছিল। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।” 

জাতির পিতা আরো লিখেছেন, “অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবাই নামকরা খেলোয়াড়। বৎসরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র, এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত।”

বঙ্গবন্ধু 'অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে' ছোটবেলার কথা লিখেছেন, “ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্ট প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম ...। সেবা সমিতির কাজ করতাম। ...  ফুটবল, ভলিবল খেলতাম। খুব ভাল খেলোয়াড় ছিলাম না। তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে (আমার) ভালো অবস্থান ছিল।”

ফুটবল ছাড়াও বঙ্গবন্ধু ভলিবল, বাস্কেটবল ও হকি খেলতেন। তিনি স্কুল ফুটবল দলের অধিনায়ক ছিলেন। তার উদ্যোগই ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে মিশন স্কুলে গড়ে উঠেছিল ফুটবল ও ভলিবল দল। স্কুলজীবনে দুর্দান্ত নৈপুণ্যর কারণে প্রাদেশিক পর্যায়ের ফুটবল দলেও জায়গা করে নেন তিনি। 

কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়া অবস্থায় তিনি সেখানকার ঐতিহ্যবাহী দুই ক্লাব এরিয়ান্স আর মোহামেডানে খেলার ডাক পেয়েছিলেন। সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যোগ দেন ঢাকার এক শৌখিন ক্লাবে। মাঠের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে তিনি অল্প দিনের মধ্যেই ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে জায়গা করে নেন। ওই সময় দেশের সেরা ফুটবলাররাই এই ক্লাবে খেলতেন। জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর ওয়ান্ডারার্সের জার্সি গায়ে মাঠ মাতিয়েছেন। 

১৯৪১ সাল থেকে আমৃত্যু ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু খেলতেন স্ট্রাইকার পজিশনে। ১৯৪৩-৪৪ মৌসুমে বগুড়ায় একটি গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল। এ টুর্নামেন্টে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। ওই ম্যাচে ফাইনালে ওয়ান্ডারার্স ৫-০ গোলে জয়ী হয়। তখনকার সত্তর মিনিটের ম্যাচে প্রথমার্ধেই বঙ্গবন্ধুর দেওয়া অসাধারণ ২ গোলে ওয়াল্ডারার্স এগিয়ে থাকে। দ্বিতীয়ার্ধে তিনটি গোল হয় তার নিখুঁত পাসে। টুর্নামেন্টে সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পান বঙ্গবন্ধু। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে প্রথম দিকে ৯ ও পরে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেছেন বঙ্গবন্ধু।

স্ট্রাইকার হিসেবে খেলার কারণে প্রতিপক্ষের জন্য ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অনেক সাফল্যের কারিগর ছিলেন তিনি। ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগের যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৮ সালে, রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তখন আর খেলা হয়নি বঙ্গবন্ধুর। তবে এর আগে খেলেছেন অনেক টুর্নামেন্টে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে বাস্কেটবলও খেলেছেন। রাজনীতির কারণে মাঠকে একটু দূরে ঠেলে দিলেও ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। 

সাবেক খ্যাতনামা ফুটবলার গজনবী বঙ্গবন্ধুর খেলা নিজ চোখে দেখেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “রাজনীতিতে ব্যস্ততার কারণে বঙ্গবন্ধু বেশিদিন খেলতে পারেননি। যদি খেলতেন তিনি চল্লিশ দশকে এশিয়ার অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হতে পারতেন।” 

বঙ্গবন্ধুর অনুপ্রেরণাতেই সেই সময়ে গড়ে উঠেছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। সেই দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, “১৯৫৫ সালে রাজনৈতিক সফরে বঙ্গবন্ধু একবার মঠবাড়িয়ায় এসেছিলেন। আমি তখন মঠবাড়িয়া স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। বঙ্গবন্ধু ফুটবল ভালোবাসতেন। তাই আমরা তাঁর সম্মানে একটি ফুটবল ম্যাচ আয়োজনের পরিকল্পনা করি। সেটা গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানাই এবং তিনি সম্মতি দেন। ম্যাচটি ছিল স্থানীয় অফিসার্স ক্লাবের সঙ্গে। ম্যাচে আমার খেলা দেখে পরে আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে বাহবা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।” 

স্মৃতিচারণ করে পিন্টু বলেন, “বাবা আমাকে ফুটবল খেলতে না দিয়ে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন। সেটা আমি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলাম। তিনি পরে আবার বাবাকে ডেকে আনেন, তার হাত ধরে বলেন নাজিমউদ্দিন (পিন্টুর বাবা) সাহেব আমাকে কথা দেন, এই ছেলেকে ফুটবল খেলতে আর বাধা দেবেন না। ওকে ফুটবলার হতে দিন। অনেক বড় ফুটবলার হবে।” 

পিন্টু আরও বলেন, “১৯৭৩ সালে মারদেকা গোল্ডকাপ খেলতে মালয়েশিয়া যাওয়ার আগে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। সেখানে আমাকে দেখেই বললেন বলেছিলাম না, তুই একদিন বড় ফুটবলার হবি। আমি তো অবাক। সেই ১৯৫৫ সালের কথা মনে রেখেছেন তিনি। ফুটবলকে অসম্ভব ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু।” 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার আমলেই ক্রীড়াঙ্গনকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। ক্রীড়াঙ্গনের কিশোর-যুবকদের সম্পৃক্ত করার তাগিদ থেকেই যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমকে নিজ থেকে খতিয়ে দেখতেন তিনি। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে (তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে) একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ফুটবল প্রতিযোগিতা মাঠে গড়ায়।

স্বাধীনতার পরে ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম ম্যাচটি উদ্বোধন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিতে তিনি ১৯৭২ সালে গঠন করেন ‘ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা’। এটি ৪৩টি ভিন্ন ভিন্ন খেলাধুলা বিষয়ক সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওই সময়ে এই সংস্থাটি শিক্ষা-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে অধীনে পরিচালিত হতো। পরে ক্রীড়াঙ্গনের আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদের পাস হয় বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল অ্যাক্ট। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার তার পরিকল্পনা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আজকের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি)। এক কথায় রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ক্রীড়াঙ্গনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) গঠন করেন তিনি। এর ঠিক দুই বছর পর (১৯৭৪ সালে) দেশের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি পেয়ে যায় ফিফা আর এএফসির সদস্যপদ। বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি), যা বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) নামে পরিচিত, এটাও ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গবন্ধু। ফুটবল আর ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্যান্য খেলা যেমন হকি, ভলিবল, বাস্কেটবল, দাবা, কাবাডি, জুডো-কারাতেসহ সব খেলাকেই সমান প্রাধান্য দিতেন তিনি। সে কারণেই ১৯৭৪ সালে বিশেষ ধরনের ক্রীড়া প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব স্পোর্টস (বিআইএস) প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রনায়ক।

১৯৮৩ সালে বিআইএস সরকারি থেকে স্বায়ত্তশাসিত ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন এর নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। এখন এই বিকেএসপি হচ্ছে দেশের সেরা ক্রীড়াবিদদের আঁতুড়ঘর! বাংলাদেশের ক্রিকেটের মহাতারকা সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম, ফুটবলার মামুনুল ইসলাম, সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শীলাসহ অসংখ্য তারকা খেলোয়াড় তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠান।

বঙ্গবন্ধুর মতো তার পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন ক্রীড়া পাগল। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল ছিলেন একজন অতুলনীয় ক্রীড়া সংগঠক ও ক্রীড়াব্যক্তিত্ব। বড় ছেলে শেখ কামাল ফুটবলে সেভাবে খ্যাতি না পেলেও ক্রিকেট, অ্যাথলেটিক্স ও বাস্কেটবল খেলে প্রশংসা পেয়েছেন। পরবর্তীতে বনে যান ক্রীড়া সংগঠক। তিনিই প্রথম এ দেশে আধুনিক ধারার ক্লাব ‘আবাহনী ক্রীড়া চক্র’ প্রতিষ্ঠা করেন।

শেখ জামালও খেলেছেন ফুটবল, অ্যাথলেটিক্স। ক্রীড়াঙ্গনে দুই ভাইয়ের ছিল অসম্ভব রকম প্রতিযোগিতা। শেখ কামাল আবাহনী গড়ার পর শেখ জামাল ১৯৭৪ সালে ঐতিহ্যবাহী আজাদ স্পোর্টিংয়ের ফুটবলে শক্তিশালী দল গড়েন। জামালের ডাকে সাড়া দিয়ে অসংখ্য তারকা ফুটবলার সেবার যোগ দিয়েছিলেন আজাদে। শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামাল খুকু ছিলেন দেশের খ্যাতনামা অ্যাথলেট। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান অলিম্পিক গেমসে লং জাম্পে নতুন রেকর্ড গড়ে সোনার পদক জেতেন সুলতানা। ১৯৭০ সালে অল পাকিস্তান অ্যাথলেটিকেস লং জাম্পে চ্যাম্পিয়ন হন সুলতানা। তখনও সুলতানা বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ হননি। ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার হার্ডলসে সোনা জেতেন সুলতানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাথলেটিকসে প্রথম নারী ব্লু পাওয়ার কৃতিত্ব সুলতানারই।

বঙ্গবন্ধুর বড় কন্যা বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বাবার মতো তিনিও ভীষণ ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ। খেলাধুলার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছোটকন্যা শেখ রেহানার অনুরাগের কথাও অজানা নয় কারও। সব মিলিয়ে ক্রীড়াবান্ধব এক পরিবার। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল তাই পরিবারটিকে বলেছেন, ‘দেশের ক্রীড়াঙ্গনের বাতিঘর’।