বিশ্ব ক্রিকেটে যেখানে ব্যাট হাতে চার ছক্কার ফুলঝুরি, সেখানে আকাশ পাতাল পিছিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট। অন্য দল যেখানে ইনিংসের শুরুতেই বোলারদের উপর চড়াও হয়ে বোলিংয়ের লাইন লেন্থের বারোটা বাজিয়ে ছাড়ে, সেখানে টাইগাররা শুরুতেই উইকেট হারিয়ে দলকে চাপের মধ্যে ফেলে দেয়।
গত কয়েক বছর ধরে টি টোয়েন্টি কিংবা ওয়ানডেতে বাংলাদেশ দলে ওপেনিংয়ে তামিমের সঙ্গীরা কেউই নিজেকে মেলে রাখতে পারেননি। সুযোগ হিসেবে অনেককে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)৷ কিন্তু কারও প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেনি টিম ম্যানেজমেন্ট। তাই প্রত্যেক সিরিজের আগে দল গঠন নিয়ে বিসিবিকে পড়তে হচ্ছে মধুর সমস্যায়।
গত কয়েক বছর ধরে টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলে নেই তামিম ইকবাল। দেশসেরা এই ওপেনার না থাকায় উদ্ভোধনী জুটিতে লিটনের সঙ্গী হিসেবে সৌম্য সরকার, মোহাম্মদ নাঈম কিংবা নাজমুল হোসেন শান্তকে একাদশে দেখা গেলেও ধারাবাহিক কোনো ফল পায়নি টিম বাংলাদেশ।
চলতি বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএলে) শান্ত নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। ফরচুন বরিশালের হয়ে কয়েকটা ম্যাচে ইনিংস শুরু করলেও তা বেশিদূর টেনে নিয়ে যেতে পারেননি তিনি।
আবার শান্ত যে খারাপ ফর্মে আছেন তেমনও নয়, এখন পর্যন্ত ১০ ম্যাচ খেলে ৮ ইনিংসে ব্যাট হাতে ১৬২ রান করেছেন তিনি। কিন্তু ম্যাচে কোনো ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারেননি এই বাঁহাতি ব্যাটার।
আরেক ওপেনার সৌম্য সরকার এবারের বিপিএলে খুলনা টাইগার্সের হয়ে ৮ ম্যাচে ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েছেন। যেখানে সিলেট সানরাইজার্সের বিপক্ষে দুই ম্যাচে ৮২* ও ৪৩ ছাড়া আসরে নেই তেমন কোনো ইনিংস। মোট করেছেন ১৬৩ রান আর তিন ম্যাচে হাত ঘুরিয়ে পেয়েছেন ৪ উইকেট।
তবে তার ব্যাট ফর্মে ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। তাই আসরে সামনের ম্যাচগুলোয় তাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।
টি টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ দলের নির্ভরযোগ্য ওপেনিং ব্যাটার মনে করা হচ্ছিল নাঈম শেখকে। কিন্তু জাতীয় দলের ওপেনার হিসেবে টি টোয়েন্টিতে ৩২ ম্যাচ খেলা নাঈমকে অটো চয়েস ভাবা হচ্ছিল। শেষ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের ভরাডুবির মাঝ্বেও তার ব্যাট হেসেছিল। কিন্তু নাঈমের সাম্প্রতিক ফর্ম তার হয়ে কথা বলছে না।
চলতি বিপিএলে মিনিস্টার ঢাকার হয়ে ওপেনিংয়েও দেখা যায়নি তাকে। আসরে তার ব্যাটিং অ্যাপ্রোচ কিংবা দলের প্রতি তার কন্ট্রিবিউশন নেই বললেই চলে। ৮ ম্যাচ খেলে ৭ ইনিংসে তার ব্যাট থেকে এসেছে মাত্র ৫০ রান। যা তার ক্রিকেট দক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
বর্তমানে টাইগার দলের এই ৩ ক্রিকেটারের কেউই তাদের স্বাভাবিক ফর্মে নেই। ফলে আসন্ন আফগানিস্তান সিরিজের জন্য টিম নির্বাচকদের আবার নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে।
নির্বাচকরা তাই চোখ রাখছেন চলতি বিপিএলে পারফর্ম করা সব ক্রিকেটারদের উপর। ফলে প্রশ্ন উঠছে ঘরের মাটিতে আফগান বধের মিশনে বিসিবি কী ওপেনিংয়ে পুরানোদের উপর আস্থা রাখবে, নাকি বিপিএলে পারফর্ম করাদের সুযোগ দেবে?
চলতি বিপিএলে তরুণ কয়েকজন ক্রিকেটার বিসিবির নজর কেড়েছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ জয়ী দল থেকে উঠে আসা কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের মাহমুদুল হাসান জয় ও ফরচুন বরিশালের মুনীম শাহরিয়ারের প্রতি বিশেষ নজর রেখেছেন নির্বাচকরা। ওপেনিংয়ে ধারাবাহিকতার অভাব দূর করতে আসন্ন আফগানিস্তান সিরিজে দেখা যেতে পারে এই তরুণ ক্রিকেটারদের যে কাউকে।
পাকিস্তানের সাথে গত বছর টেস্ট অভিষেকের পর এ বছর নিউজিল্যান্ডের মাটিতে প্রথম জয়ের টেস্ট ম্যাচে তুলে নিয়েছেন দুর্দান্ত এক অর্ধশতক। এবারের বিপিএলে এখন পর্যন্ত ৮ ম্যাচে ৭ ইনিংসে ২০৭ রান করেছেন এই ব্যাটার। যেখানে ৩০ ছুইছুই গড়ের সঙ্গে প্রায় ১২৪ স্ট্রাইক রেট বিসিবি নির্বাচকদের আলাদাভাবে ভাবিয়ে তুলবে।
এই তালিকায় আরেক নাম ফরচুন বরিশালের উদ্ভোধনী ব্যাটার মুনীম শাহরিয়ার। প্লেয়ার ড্রাফট থেকে দলই পাননি তিনি। পরে ভাগ্যের জোরে সাকিব আল হাসানের দলে সুযোগ পান মুনীম।
কিন্তু বিপিএল শুরুর আগেই উইকেটকিপার ব্যাটার নুরুল হাসান সোহানের সঙ্গে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। এরপর আইসোলেশনে থেকে সুস্থ হয়ে মাঠে ফিরেন মুনীম। তার দল আসরের শুরুতে টপ অর্ডারে রীতিমত খারাপ করলে সুযোগ পান একাদশে। নিজের প্রথম ম্যাচে মাত্র ১ রানেই বিদায় নেন ডানহাতি এই ব্যাটার।
পরের ৩ ম্যাচে মাঠে ঝড় তুলে দলের কোচ খালেদ মাহমুদ সুজন ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের প্রশংসায় ভাসেন। তাই নির্বাচকরা তাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতেই পারেন।
গ্রুপ পর্বের শেষ ৩ ম্যাচে ব্যাট হাতে আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছেন ময়মনসিংহের এই ক্রিকেটার। প্রথম ম্যাচ বাদ দিলে বাকি ৩ ম্যাচের পরিসংখ্যান এমন ২৫ বলে ৪৫, ২৮ বলে ৫১ ও ২৫ বলে ৩৭ রান। ওপেনিংয়ে ক্যারিবিয় দানব ক্রিস গেইলকে পাত্তা না দিয়ে নিজের সহজাত ক্রিকেট উপহার দিচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। ফরচুন বরিশালের একাদশে তার অন্তর্ভুক্তি পুরো দলের চেহারা পাল্টে দিয়েছে।
২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে আফগানদের সঙ্গে ৩ ম্যাচের ওয়ানডে ও ২ ম্যাচের টি টোয়েন্টি সিরিজ। এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় দলের নির্বাচকরা ওপেনিংয়ে অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করবেন নাকি খেলোয়াড়দের ঘরোয়া ক্রিকেট আর বিপিএলের পারফর্মেন্সকে মূল্যায়ন করবেন - সেটিই এখন দেখার বিষয়।