যেকোনো রবীন্দ্রনাথ পাঠ মানেই একটি অসমাপ্ত পাঠ

আজফার হোসেন প্রকাশিত: মে ৮, ২০২৪, ১১:২৪ এএম
যেকোনো রবীন্দ্রনাথ পাঠ মানেই একটি অসমাপ্ত পাঠ

(রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা আমার তুলনামূলকভাবে পুরাতন এক দীর্ঘ রচনার পরিবর্ধিত ‍‍‘ভার্সান‍‍’ থেকে এখানে কিছু অংশ পেশ করলাম)  

১৯২১ সালে লেখা ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধটিতে আমরা যে তেজ লক্ষ করি, তা সব সময় আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলোতে তেমন লক্ষ করি না। প্রবন্ধের প্রায় শুরুতেই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, “মানুষের সবচেয়ে বড় স্বভাব হচ্ছে মেনে না নেওয়া। জন্তুরা বিদ্রোহী নয়, মানুষ বিদ্রোহী”।

হ্যাঁ, এই মেনে-না-নেওয়ার বিষয়টি প্রবন্ধের প্রায় সমস্ত অংশেই লক্ষ করার মতো। না, তিনি পূর্বের সবকিছুই মেনে নিতে চাইছেন না, যেমন পশ্চিমের দাপট ও আধিপত্যকেও মেনে নিচ্ছেন না মোটেই। এভাবেই তিনি পূর্ব ও পশ্চিম কোনোটাকেই আদর্শায়িত বা রোমান্টিকায়িত করছেন না। স্পষ্ট করেই তিনি বলছেন, কেবল অতীতে ফিরে যাওয়ায় যেমন মুক্তি নেই, ঠিক তেমনি বর্তমানকে মেনে নেওয়ার ভেতরেও মুক্তি নেই। তবে তিনি প্রবন্ধটিতে “নিখিল মানবের মুক্তির” স্বার্থেই ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যেই পরিবর্তনকামী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। বলেছেন তিনি, “আমাদের সর্বপ্রথম সমস্যা হচ্ছে শিক্ষাসমস্যা”। এই রবীন্দ্রনাথ আজ বড় বেশি প্রাসঙ্গিক।

আর এই রবীন্দ্রনাথই বলে দিচ্ছেন যে, পশ্চিমা শিক্ষার অন্ধ অনুকরণে যেমন মুক্তি নেই, পশ্চিমা শিক্ষার অন্ধ বর্জনেও তেমনি ‘অগ্রগতি’ সম্ভব নয়। পূর্বের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বোঝাতে চাইছেন, যে-শিক্ষা সর্বসাধারণের মুক্তির পক্ষে কাজ করে না, তা চূড়ান্ত দৃষ্টান্তে অকেজোই বটে, যদিও রবীন্দ্রনাথের ‘সর্বসাধারণ’এবং মুক্তি’ ও ‘অগ্রগতি’র ধারণা নিয়ে নির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠতেই পারে। তবে রবীন্দ্রনাথের কাজের ‘স্পিরিট’টা স্পষ্ট থাকে: বিদ্যা-দখলের স্বার্থে বারবারই প্রশ্ন তোলা জরুরি, যেমন তিনি নিজেই এমনকি ‘মিলন’ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর অন্যান্য ‘মিলন’ ও ঐক্য-সংক্রান্ত কাজের অবস্থানের বিপরীতেই।

এ-ও সত্য যে উপনিষদীয় ঐক্যচেতনায় অনেক সময় গদগদ হয়ে রবীন্দ্রনাথ মিলনের ডাক দিয়েছেন আন্তরিকতা সহকারেই। কিন্তু ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কেবল ওই মিলনকে প্রশ্নই করছেন না; বরঞ্চ এও বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, মিলন অত সহজ নয়, যদিও ওই উপনিষদীয় ঐক্যচেতনাই রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধটির জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। বলা যাবে যে, ওই ঐক্যচেতনার একধরনের উপনিবেশবাদবিরোধী রাজনীতিকীকরণ ঘটেছে ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধটিতে। তাই মিলনের বিষয়টি প্রত্যাশিত বটে, তবে তা একই সঙ্গে সংগ্রামেরও, যে সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে পরিবর্তনকামী ও জীবনঘনিষ্ঠ শিক্ষা, যে শিক্ষা বস্তুজগতের জ্ঞানকে অস্বীকার করে না, যেমন অস্বীকার করে না ভাবজগতের জ্ঞানকেও। বিশ্বের নিয়ম এবং বুদ্ধির নিয়মের পরস্পর-সম্পর্কিত লেনদেনকে জরুরি বিবেচনা করে বস্তুজগৎ ও ভাবজগতের  মধ্যে কিংবা জীবন ও চেতনার মধ্যে এঁকে-দেওয়া সনাতন বিভাজন রেখাকে রবীন্দ্রনাথ অস্বীকার করেছেন। না, রবীন্দ্রনাথ মার্কসের ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ রপ্ত করেননি, যদিও তাঁরই নিকটাত্মীয় এবং স্নেহভাজন কমিউনিস্ট সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবাদেই রবীন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হয়েছিলেন। বন্ধনীতে বলে নেয়া যায়, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরই ভারতে প্রথম কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো অনুবাদ করেন। তা তিনি করেন বাংলা ভাষাতেই।

তাহলে ওপরের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে বলা যাবে যে, রবীন্দ্রনাথ সাহেব হতে চাননি, এমনকি ঋষিও নয়। নিদেনপক্ষে ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধটিতে তা ধরা পড়ে স্পষ্ট করেই, যদিও আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন মুনাফার স্বার্থেই সাহেবকে ঋষি এবং ঋষিকে সাহেব বানাতে চায়। ‘শিক্ষার মিলন’প্রবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের লেনদেনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেন। তিনি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন যে, বিভিন্নতা বাদ দিয়ে সংহতি কাঙ্ক্ষিত নয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “এই ঐক্যতত্ত্ব সম্বন্ধে আমার কথা ভুল বুঝবার আশঙ্কা আছে। তাই যে কথাটা একবার আভাসে বলেছি সেইটে আর একবার স্পষ্ট বলা ভালো। একাকার হওয়া এক হওয়া নয়। যারা স্বতন্ত্র তারাই এক হতে পারে। পৃথিবীতে যারা পরজাতির স্বাতন্ত্র্য লোপ করে তারাই সর্বজাতির ঐক্য লোপ করে। ইম্পিরিয়ালিজম হচ্ছে অজগর সাপের ঐক্যনীতি; গিলে খাওয়াকেই সে এককরা বলে প্রচার করে”। 

রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো এত স্পষ্ট যে, এগুলো বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। তবে বলা প্রয়োজন যে, রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো আজ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। আজকের মার্কিনায়নের মাধ্যমে ইম্পিরিয়ালিজম যে অজগর সাপের ঐক্যনীতি অব্যাহত রেখেছে, তা তো খোলা চোখেই দেখা যায়—কোকাকোলায়ন থেকে দুনিয়ার মার্কিন সামরিকায়ন পর্যন্ত। তবে রবীন্দ্রনাথ ইম্পিরিয়ালিজমের উদরনীতির সঙ্গে উদারপন্থি উদরনীতির যোগাযোগটা তেমনটা ধরতে পারেননি বলে মনে হয়, যেমন ধরতে পারেননি কীভাবে ইম্পিরিয়ালিজমের ঐক্যনীতি আসলে বিভাজননীতিরই অপর পিঠ—এই বিভাজন ও বৈষম্য শ্রেণীর, লিঙ্গের, বর্ণের।
তবে ‘শিক্ষার মিলন’প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বায়ন নয়, একেবারে আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের চিত্র এঁকেছেন এবং তার এক ধরনের সমালোচনাও হাজির করেছেন বটে, সেই ১৯২১ সালেই। তারও আগে, ১৮৪৮ সালে, মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোতে আরো শানিতভাবে আজকের বিশ্বায়নের ছবি এঁকেছেন, যেন মনে হয়, “ম্যানিফেস্টোটি গতকাল লেখা হয়েছে,” যে-কথাটা একুশ শতকের গোড়াতে যথার্থই বলেছিলেন মিশরীয় রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ সমির আমিন। 

এবারে বিশ্বায়ন নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু কথা হাজির করা যাক, যদিও রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই ‘বিশ্বায়ন’ বর্গটি ব্যবহার করেননি: “বিজ্ঞানের কল্যাণে জলে-স্থলে-আকাশে আজ এত পথ খুলেছে, এতো রথ ছুটেছে যে, ভূগোলের বেড়া আজ আর বেড়া নেই। আজ কেবল নানা ব্যক্তি নয়, নানা জাতি কাছাকাছি এসে জুটল; অমনি মানুষের সত্যের সমস্যা বড় হয়ে দেখা দিল। বৈজ্ঞানিক শক্তি যাদের একত্র করেছ তাদের এক করবে কে? মানুষের যোগ যদি সংযোগ হল তো ভালোই, নইলে সে দুর্যোগ। সেই মহাদুর্যোগ আজ ঘটেছে। একত্র হবার বাহ্যশক্তি হু হু করে এগোল, এক করবার আন্তরশক্তি পিছিয়ে পড়ে রইল। ঠিক যেমন গাড়িটা ছুটেছে এঞ্জিনের জোরে, বেচারা ড্রাইভারটা আরে আরে হ্যাঁ হ্যাঁ করতে করতে তার পিছন পিছন দৌড়েছে, কিছুতে নাগাল পাচ্ছেনা। অথচ একদল লোক এঞ্জিনের প্রচণ্ড বেগ দেখে আনন্দ করে বললে, সাবাস, একেই তো বলে উন্নতি”।

না, রবীন্দ্রনাথ এই ধরনের ‘উন্নতি’ চান না; আজকের বাংলাদেশে ও আজকের দুনিয়ায় আমরাও চাই না। এর অর্থ এই নয় যে, আমরা বিজ্ঞানকে বর্জন করব, পশ্চিমা প্রযুক্তিকে বর্জন করব। কিন্তু যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সর্বসাধারণের মুক্তি আনে না, সেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অসম ব্যবহারকে প্রশ্ন করা চাই। সর্বোপরি যে ব্যবস্থা ওই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে সবার কাজে ও সবার উন্নতিতে ব্যবহার করতে দেয় না, সেই ব্যবস্থারই খোলনলচে পাল্টে ফেলা জরুরি। এই ব্যবস্থার নাম সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ওই ব্যবস্থাকে ‘ইম্পীরিয়ালিজম’ নাম দিয়ে খানিকটা শনাক্ত করেছেন বটে, যদিও ওই ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের দিকে তিনি যাননি। তাই এই রবীন্দ্রনাথকেই ‘নিখিল মানবের মুক্তির’ লক্ষ্যে সম্প্রসারিত করা চাই।

না, পুতুপুতু রাবীন্দ্রিকতা নয়, চাই বর্তমান সময়ের তাগিদেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বোঝাপড়া, যে বোঝাপড়ার ওপর রবীন্দ্রনাথ নিজেই জোর দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কত শত বিষয় নিয়ে ভেবেছেন ও লিখেছেন। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের চূড়ান্ত ও একমাত্রিক চরিত্রায়ণ যেমন ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি সহজ হয়ে পড়ে তার স্ববিরোধিতা শনাক্ত করাও। অবশ্যই স্ববিরোধিতাকে দেখানোর জন্যই কেবল স্ববিরোধিতাকে চিহ্নিত করা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। তবে রবীন্দ্রনাথের বিষয়বৈচিত্র্য নিজেই ওই প্রশ্নটাকে সামনে আনতে সাহায্য করে: কোন্ রবীন্দ্রনাথ? আর সেক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কাজ নিয়েও প্রশ্ন ওঠে বৈকি। আর তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করা নয়। বরং বর্তমান সময়ের তাগিদেই ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে তাঁকে সম্পর্কিত করার লক্ষ্যেই তাঁর সঙ্গে আমাদের বোঝাপড়া জরুরি হয়ে পড়ে। আর হ্যাঁ, যেকোনো রবীন্দ্রনাথ পাঠ মানেই একটি অসমাপ্ত পাঠ।