অবমাননার প্রয়োজনে কোনো জাতি, জনগোষ্ঠী, ধর্মগোষ্ঠী, রাষ্ট্রের নাম বিকৃত করাটা অরুচিকর। বাকিদের তুলনায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের এটা একটা মাধ্যম। এই সহজ কারণেই কাজটা পরিত্যাজ্য। আলোচনা এখানেই শেষ হতে পারে।
এর বাইরে কোনো মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে, অমুক অমুক বৈশিষ্ট্য বা ত্রুটি/দোষ বা এমন কিছু বোঝাবার উদ্দেশ্যে বাঙ্গু শব্দটি ব্যবহার করার দাবি করেন কেউ কেউ। তাদের কারও কারও উদ্দেশ্যের সততার বিষয়ে আমার আস্থাও আছে। তারপরও শ্রদ্ধা ও বিনয় সহকারেই বলতে চাই, যে যে বৈশিষ্ট্য বোঝাবার জন্য আপনারা এই বাঙ্গু শব্দটি ব্যবহার করেন, সেগুলো কেন আপনাকে ব্যাখ্যা করতে হয়? কারণ তো খুব সোজা—
১. সেগুলো বোঝাবার জন্য বাঙলা ভাষায় অন্য কিছু নির্দিষ্ট শব্দ আছে।
২. অমুক অমুক যে বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝাবার জন্য আপনি বাঙ্গু ব্যবহার করছেন, সেগুলো মানুষ বুঝতে পারছে না। তারা বাঙালির সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে এগুলোকে ধরছে।
বাঙ্গু শব্দটি রেন্ডিয়া, পাকি, কাঙলাদেশ ইত্যাদি সকল বর্ণবাদী শব্দের মতই আরেকটি নোংরা শব্দ। কোনো মহৎ লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের দোহাই দিয়ে সেটাকে বৈধ করা যায় না।
বাঙ্গু শব্দটির জন্ম নির্ণয় হয়তো সম্ভব না। কারা এর ব্যবহার বেশি করেন, সেটাও একেকজনের চোখে একেকরকম ভাবে ধরা পরবে। একটা কারণ, কাদের ব্যবহার আপনার সামনে ঘটছে। আরেকটা কারণ, আপনি কোনোভাবে এই ব্যবহারটাকে গ্রহণীয় বা অগ্রহণীয় বলে মনে করেন, আপনার মনের সেই বিশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী আসলে আপনি খেয়াল বা বেখেয়াল করবেন এর ব্যাবহার।
যেমন আমার পর্যবেক্ষণে, এইটা বেশি ব্যবহার করেন এমন লোকদের মাঝে নিজেদের বিষয়ে একটা শ্রেয়তরতার ঝোঁক দেখেছি। বিশেষ ঝাঁঝ সহযোগে এটা যারা ব্যাবহার করেন, তারা মূলত
১. প্রবাসী বাঙালি, যারা বিদেশে আছেন বলেই দেশে থাকাদের তুলনায় নিজেদের শ্রেয়তর মনে করেন।
২. ইংরেজি ভাষার ওপর বিশেষ দক্ষতা আছে এমন ব্যক্তিরা, যারা দুনিয়ার শিল্প সাহিত্যে নিজেদের পরিচয়ের সুযোগ আছে বলে দেশীয়দের রুচিকে হীনতর মনে করেন। কৌতূহল জাগানো একটা ঘটনা হলো, এদের অনেকের ক্রিকেট ও ফুটবল জ্ঞান ভালো বলে তাদের সঙ্গ একঘেয়ে হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার নিজেরও ভালো লাগে।
৩. নিজেদের সমাজ বা রাষ্ট্র বা ধর্ম বোঝার সক্ষমতাকে অন্যদের তুলনায় বেশি ভালো মনে করেন। কিন্তু দীর্ঘ আলোচনার যে প্রক্রিয়ায় সমাজকে যেতে হয় সংস্কার বা রূপান্তরের জন্য, তাতে আগ্রহ কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সক্ষমতা নেই বলে প্রধানত অসহিষ্ণুতাবশতঃ এই রকম কিছু শব্দ ব্যবহার করেন। সন্দেহ নেই যে এদের অনেকেরই অনেক মৌলিক পর্যবেক্ষণ ভালো লাগবে আপনার। কারও কারও পর্যবেক্ষণ হাস্যকরও ঠেকবে। কারণ কারও কারও বেলায় সেটা নিছক প্রতিভাহীনতা হলেও, কখনো কখনো দেখবেন অস্থিরতার কারণে নিজের ভাবনাকেও যাচাই না করা সৃজনশীল মানুষেরাও এই তালিকায় আছেন।
৪. নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষ (সেটা মহৎও হতে পারে) বঙ্গবাসী জনতা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে বলে তাদের এই অভিধায় ভূষিত করেন। এটা একরকম প্রবল হতাশার বোধ থেকে আসে। যেন মানুষকে, তাদের রুচিকে, তাদের বোধবুদ্ধিকে চরমতম উপায়ে আক্রমণ করলে তারা নড়বে। সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমার অভিজ্ঞতা বলে মানুষ এইভাবে নড়ে না।
৫. বাঙালি বা বঙ্গবাসী বলে নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করা কেউ কেউ নিজেদের বর্গটিকে সাধারণ রুচি থেকে বিশ্লিষ্ট করার জন্য যখন এটা করেন। এমন কয়েকজনকে আমি চিনি যারা শুধু মাত্র এইরকম অবমাননার প্রয়োজনেই বাঙলা ব্যবহার করেন, অন্য সময়ে ইংরেজি। দেশবাসীকে ‘উদ্ধার’ করবার রাজনৈতিক অভিলাষের চাইতে এদের মাঝে দেশবাসীর প্রতি তাচ্ছিল্যর অনুভূতিটা বেশি।
তাচ্ছিল্য? হ্যাঁ, যে উদ্দেশ্যেই আমার দেখা এই মানুষগুলো এই শব্দটিকে ব্যবহার করেন না কেন, এর মাঝে তাচ্ছিল্যের প্রদর্শনটাই সব চাইতে বেশি বলে আমার মনে হয়।
এটা আসলে কষ্টকরও, এত এত বিপুল সংখ্যার বুদ্ধিমান, ভাগ্যবান, প্রতিভামান বাঙালি স্বজাতিকে বাঙ্গু বলে তাচ্ছিল্য করে। মানুষের মনোজগত নিয়ে কিছু হাতুড়ে ধারণা থেকে বলতে পারি, এই আঘাত সহ্য করাও অনেক মানুষের জন্য কঠিন। বর্ণবাদী যে কোনো গালির মতই আক্রান্ত কেউ কেউ এটাতে অনেক সময় অভ্যস্তও হয়। কখনো কখনো রক্ষা কবচ হিসেবে এটার ব্যবহার নিজেও শুরু করে। এটার সাথে তুলনীয় প্রবল পুরুষালী কৌতুকগুলো পরিবেশের চাপে যেমন নারীরা নিতে না পারলেও সহ্য করেন কখনো কখনো।
এই রকম আরও কেউ কেউ থাকতে পারেন। একদমই নিজের চারপাশ থেকে পাওয়া পর্যবেক্ষণ এটা। সকলেরই নিজ নিজ ছোট গণ্ডি আছে। ফলে সকল পর্যবেক্ষণই নিজগুণে সীমিত।
আমি এই শব্দটাতে ব্যক্তিগতভাবে আহত হই না। বরং একটা সামষ্টিক আঘাত বোধ করি। এই কষ্টটা হয়তো বোঝানোও যাবে না। কিন্তু অন্যদিকে যারা ব্যবহার করছেন, তারাও নিশ্চয়ই অনেক রকম ব্যথা, একাকীত্ব, সমগ্রের অংশ হতে না পারার তাড়না থেকেই এটা করে থাকেন। তাদের অত বেশি দোষ তাই ধরি না যে তাদের জীবন থেকে বর্জন করবো।
থাকুক। ইতিহাসের এই সময়ে এমনটাই হয়তো আমাদের নিয়তি, প্রতিভা, ভাগ্য বা মেধার গুণে আমাদের মাঝে সক্ষমতরদের একটা বড় অংশ নিজের মানুষদের জন্য তাচ্ছিল্য ছড়িয়ে যাবেন।
আরেকটা সম্ভাবনার কথা বলি, নিছকই সম্ভাবনা। আপাত দৃষ্টিতে এটা নির্দিষ্ট কারও ক্ষতি না করেও নিজের জন্য নিরাময়করও বোধ হতে পারে। এটা হয়তো তাকে ব্যক্তিগতভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে রাগ ক্রোধ হতাশাকে খানিকটা প্রকাশের সুযোগ দিয়ে, কিন্তু ঠিক ব্যক্তিগতভাবে তো অপর কারও গায়ে লাগছে না।
কিন্তু মনে রাখা দরকার, এই পথ প্রশমনের না। বরং তাতে ওই ব্যক্তিগত মানসিক দশাগুলোই আরও ঘনীভূত হবে। আর ব্যক্তিগতভাবে না নিলেও সামষ্টিকভাবে যে যে বা যারা যারা এই গালিটুকুকে হজম করলেন, তাদের জন্য এটা বেহতর কিছু হবে না।
কিন্তু আমার কথা ওই প্রথম অধ্যায়ের কথাটুকুই। যারা দেশবাসীকে বাঙ্গু বলেন, (কিংবা দেশবাসীকে বলেন না, কিন্তু দেশবাসীর একটা বড় অংশ হয়তো নিজের গায়ে নিয়ে নেন) তারা হয়তো নিজেদের মানসিক উপশমের জন্য জনগোষ্ঠীকে আঘাত করছেন, তাদের মনে রাখা উচিত যে এটা বর্ণবাদী। এই কারণেই আমার পর্যবেক্ষণগুলো ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, এটার ব্যবহার বন্ধ করা উচিত।
আমার খুব পছন্দের একজন কবির সাথে গলা মিলিয়ে বলতে চাই, আমাকে বাঙ্গু, ছাগু, রেন্ডিয়া, পাকি, বিহারী, চিঙ্কু চারুবিজ্ঞানী সবই নিশ্চিন্তে বলবেন। ‘আরও একটি বাঙ্গুসুলভ মূল্যায়ন’ শিরোনাম দিয়ে এই পোস্ট শেয়ারও করতে পারেন। কিন্তু নিজস্ব ‘মহৎ’ উদ্দেশ্য সাধনের নামে এই ‘অরুচিকর’ এবং ক্ষতিকর পদ্ধতি বন্ধ করলে হয়তো আলোচনা, আলাপ, সংলাপের পথটা আরেকটু খুলবে।
শুভ কামনা থাকলো।