সময় পিছনে যায় না, সে সর্বদা সম্মুখগামী। থামে না কখনো, ক্রমাগত এগিয়েই চলে। ১৯৩৬ থেকে ২০২১। কালের প্রবাহে ৮৫ বছর। যেকোনো মানুষের জীবনের দৈর্ঘ্য হিসেবে একেবারে ছোট নয়। কিন্তু সৃজনশীল মানুষের কাছে মনে হয় এত দ্রুত কেটে গেল সময়গুলো! কত কাজ বাকি আছে এবং করতে হবে আরও অনেক কাজ। আর যারা তার সৃষ্টির ছিঁটেফোটার স্বাদ পেয়েছে তাদের কাছে মনে হয় আরও কত কিছু না যেন আছে বাকি। তার সৃষ্টির অনাবিষ্কৃত খনি থেকে আরও কত মনি মুক্তা যে বের হবে তার অপেক্ষায় থাকে তাঁরা।
কৈশোরে মুগ্ধ হওয়ার মত অনেক বিষয় থাকে, মুগ্ধ করার মতো অনেক ব্যক্তিও থাকেন। কৈশোরের সেই মুগ্ধতা যৌবনে ঠিক আগের মতো থাকে না। মধ্যবয়স থেকে প্রৌঢ়তায় উত্তীর্ণ হলে যিনি কৈশোরে মুগ্ধতা ছড়ানো মানুষ ছিলেন তিনি আর মুগ্ধতার আবেশ ছড়াতে পারেন না। তাকে তখন অনেকটা ক্লিশে মনে হয়। কিন্তু এমন কেউ থাকেন যার মধ্যে সৃষ্টিশীলতার এমন এক দ্যুতি থাকে, যা চমকের পর চমক লাগিয়ে দেয়। তাদের দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। আমাদের কাছে তেমন একজন মানুষ প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। যার কথায় উন্মোচিত হয় চিন্তার “নতুন দিগন্ত” আর লেখায় ফুটে উঠে “শ্রেণি, সময় ও সাহিত্য”। শ্রদ্ধায় যাকে স্যার বলে ডাকতে কোন দ্বিধা হয় না। তিনি তার জীবনের ৮৫ বছর পার করে ৮৬-তে পা দিচ্ছেন আজ।
আমাদের কৈশোরকালে ‘সময় বহিয়া যায়’ ভাব ও ভাষার গতিময়তার সাথে পরিচিত করে দিয়েছিল। কী অপূর্ব ভাষার গাঁথুনি! সব না বুঝেও অবলীলায় পড়ে যাওয়া যায় প্রবন্ধের শেষ পর্যন্ত। একটা স্বপ্নের সমাজের জন্য বর্তমানকে ব্যাখ্যা করা ও পাল্টানোর তাগিদ তৈরি করে দিয়েছিল সে লেখাগুলো। প্রতি বৃহস্পতিবার সংবাদ পত্রিকার অপেক্ষায় থাকতাম। একটা বিষয় তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, যে ব্যবস্থা চলছে তা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সাময়িক কোনো ঝলক দেখালেও এই সমাজ বেশির ভাগ মানুষের জীবনে নামিয়ে আনছে অন্ধকার। সে অন্ধকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামগ্রিকভাবে সাংস্কৃতিক। মুক্তির পথ তাই সুনির্দিষ্ট এবং সেটা সম্ভব সমাজতন্ত্রে। ব্যক্তিগত মালিকানার সমাজকে সামাজিক মালিকানার সমাজে উন্নীত করার দায়িত্ব পালন না করে মুক্তির আশা করা বাতুলতা। শোষণহীন সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের তাগিদ তৈরি করতে যে যুক্তি, উদাহরণ ও বিশ্লেষণ তিনি হাজির করতেন তা মুগ্ধ করত। সংকটে বিচলিত না হয়ে সংকটের কারণটা খোঁজার মন তৈরি হয় তার লেখায়। এখনও যেন ‘ভরসার জায়গাজমি’ পেতে ইচ্ছে করে তার লেখাতেই।
পেশায় শিক্ষক ছিলেন তিনি। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটা সময়ে অবসর নিয়েছেন সেখান থেকে। কিন্তু কিশোর বয়স থেকে লিখে নিজেকে প্রকাশ করাই শুধু নয়, সমাজের অন্তর্গত বেদনা, বিক্ষোভের কার্যকারণ তুলে ধরার যে কাজ করার জন্য হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন তার আর অবসর নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে ছাত্রদের সামনে চিন্তার দিগন্ত উন্মোচন করে আনন্দ পেয়েছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু আনন্দের সাথে কর্তব্য পালন করেছেন শত শত প্রবন্ধ লিখে, পত্রিকা ও বই প্রকাশ করে। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা শতাধিক। সে সব পাঠ করে কত সহস্র তরুণ, যুবক যে স্বেচ্ছায় তার ছাত্র হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছাত্রের শিক্ষক তিনি।
প্রবন্ধ লিখে কেন তিনি এতটা জনপ্রিয় হলেন, কেনই বা মানুষ তার প্রবন্ধ পড়েন? কী আছে তার লেখায়, যা অসংখ্য পাঠককে আকর্ষণ করে ও উদ্বুদ্ধ করে বা ভাবিয়ে তোলে? আপাত তুচ্ছ বা লোমহর্ষক সকল ঘটনার যে কার্যকারণ আছে তা তিনি কত সহজেই না তুলে ধরেছেন তার লেখায়। আমরা যে সবাই কারাগার ও কল্পলোকে বসবাস করছি, গণতন্ত্রের গালভরা কথার আড়ালে ‘রাষ্ট্র ও কল্পলোক’ আড়াল হয়ে আছে। সে কথা যেমন স্বচ্ছন্দে জানিয়েছেন তেমনি ‘রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সামাজিকতা’ তুলে ধরেছেন সব বয়সী পাঠকের সামনে। দেখিয়েছেন ‘ছত্রভঙ্গের পূর্বাপর’ ‘সেই অখণ্ড বৃত্তে’ বসবাস করতে করতে কিভাবে ‘বাঙালির জয় পরাজয়’ ঘটছে। এত সমস্যা দেখে আর এত কিছু বুঝেও কেন মানুষ পালটাতে চাইছে না, যে মধ্যবিত্ত একসময় সকল আন্দোলনে সামনের কাতারে থাকত তার কারণটাও তুলে ধরেছেন তিনি। দেখিয়েছেন কিভাবে ‘স্বাধীনতার স্পৃহা সাম্যের ভয়’ পাশাপাশি চলছে। যার ফলে ‘এর পথ ওর প্রাচীর’ হিসেবে পথ আগলে রাখছে, দিচ্ছে না সামনে এগুতে।
শিক্ষা তার সবচেয়ে পছন্দের বিষয়। শুধু শিক্ষকতা করাই নয় শিক্ষার দর্শন, শিক্ষার বিস্তার এবং শিক্ষার দায় নিয়ে ভেবেছেন, ভাবিয়েছেন এবং আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। শিক্ষা কতটুকু বিস্তৃত হলো সে আলোচনার সাথে সাথে ‘দীক্ষার খবরাখবর’ কি তার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। দীক্ষাটা যদি হয় পুঁজিবাদী তাহলে যত শিক্ষিত হবে তত যে ভরসার চাইতে ভয়ের ব্যাপার হয়ে উঠবে তা তিনি সব সময়ই লিখে এসেছেন। আজ যে ভেজালে পূর্ণ সমাজ, এমনকি রাজনীতি, প্রশাসন, বিচার সবক্ষেত্রেই নিম্নগামী মানসিকতা তাতো পুঁজিবাদী, শোষণমূলক দীক্ষার ফল। এ কথাটা চোখে আঙুল আর মনে আঘাত দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
যিনি ‘এরিস্টটলের কাব্যতত্ত্ব’ অনুবাদ করে যেমন তিনি অতীতের সাথে সংযোগ ঘটান বর্তমানের তেমনি সেই পথ কি ভাবে ভবিষ্যতের সিঁড়ি হয়ে তা ও দেখিয়েছেন। সিঁড়ি মানে ক্রমাগত উচ্চতায় ওঠা যদিও অধঃপতনের সিঁড়িও যে আছে তা মনে করিয়ে দেন তিনি। পড়তে পড়তে ইতিহাসে আগ্রহী করে তোলাই শুধু নয় কাব্য চর্চার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিতর্কে নামিয়ে দেন পাঠককে। মানুষ কিভাবে ক্রমাগত মানুষ হয়ে উঠছে, যুক্তি করার ক্ষমতা মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের কোন পার্থক্য নেই একথা বোঝাতে যত ধরনের উদাহরণ সম্ভব সবই প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন তিনি। কারণ তিনি বোঝাবার চেষ্টা করেছেন সমাজের যত ধরনের বৈষম্য আছে তার মধ্যে আদিমতম বৈষম্য নারী পুরুষের মধ্যে। মানবসমাজের অগ্রগতির পথে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই বৈষম্য বড় বাধা। কখনো ধর্মের নামে, কখনো লোকাচারের নামে চলে আসা এই যে বৈষম্য তা নিয়ে মানুষকে ভাবিয়ে তুলতে চেয়েছেন তিনি। ধ্রুপদী সাহিত্যের কন্যাদের বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে ‘শেক্সপিয়ারের মেয়েরা’ কেমন চরিত্রের তা তার অপূর্ব বর্ণনায় তুলে ধরেছেন। নারীরা যে আবেগে, যুক্তিতে, স্নিগ্ধতায়, শক্তিতে পুরুষদের প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে তা যেমন তুলে ধরেছেন পাশাপাশি বঞ্চনা আর বেদনা যে কত তাদের জীবনে সেই সত্য আড়াল থাকে না তার লেখায়।
ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে চাইলে, ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ সম্পর্কে জানতে চাইলে তার দীর্ঘ পরিশ্রমে লেখা বই শুধু সুখপাঠ্যই নয়, প্রয়োজনীয় পাঠ্য। মুক্তি এক আরাধ্য বিষয়। সংগ্রামীদের জিজ্ঞাসা ‘কত মূল্য লইবে ইহার’ তা জানা যেমন জরুরি, ‘বিচ্ছিন্নতায় অসম্মতি’ তেমনি এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ইতিহাস চিরে তিনি দেখিয়েছেন বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য যেমন ষড়যন্ত্র ছিল, বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবার তেমনি অনুষঙ্গ ও অজ্ঞতাও ছিল। জনগণের স্বপ্ন পূরণের সংগ্রাম ও ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা দুটোই জরুরি। একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটাতে সফল হওয়া যাবে না।
এ কথা প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন যে, শাসক শুধু ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় থাকে না, প্রলোভনের শক্তিটাকেও কাজে লাগায়। ফলে প্রতিরোধের শক্তি গড়ে তুলতে হবে ক্ষমতাসীনদের দুই ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধেও। নিজের জীবনে তিনি সেটা করেছেন এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন। ওসমানী উদ্যানের গাছ কাটা প্রতিরোধ, লালনের আখড়া রক্ষা, আড়িয়াল বিলের জলাভূমি ও কৃষিজমি ধ্বংস করে বিমান বন্দর তৈরির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার আন্দোলন কিংবা অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী পালন সমস্ত কাজেই তিনি অভিভাবকের মত আছেন। সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী সংঘেরও তিনি আহবায়ক। তিনি হয়তো জানেন না যে, তার উপস্থিতিটাই আন্দোলনকারীদের কাছে কত বড় প্রেরণা ও শক্তি। এসব আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে শত্রু চিনিয়েছেন তিনি। শত্রু যে বেশেই আসুক না কেন তিনি স্পষ্টভাবেই তাকে চিহ্নিত করেছেন। তা হলো পুঁজিবাদ। আর মুক্তি কোন পথে তা বলতে কখনো দ্বিধা করেননি। সে তো সমাজতন্ত্রের পথেই। পথ যত দুর্গম হোক না কেন মানবমুক্তির এই তো নিশানা। শিক্ষার আন্দোলনে, সামাজিক আন্দোলনে এবং সমগ্র জীবনব্যাপী লেখালেখির মাধ্যমে সে পথেই জনগণকে আহবান করছেন তিনি।
সমাজতন্ত্র তার কাছে শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মানুষকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নয়। তার কাছে সমাজতন্ত্র এক উন্নততর সমাজ ও সংস্কৃতি। এ সমাজ সদিচ্ছা দিয়ে তৈরি হবে না। এ জন্য প্রয়োজন সমাজের খোলনলচে বদলে ফেলার লড়াই। তাই অক্টোবর বিপ্লবের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য আলোচনা করতে করতে তিনি উপসংহার টেনেছেন যে আজো ‘লেনিন কেন জরুরী’।
জনগণের কাছে তিনি তাই সৃষ্টিশীলতা, গতিময়তা আর নিরলস সংগ্রামী এক চরিত্রের নাম। শিক্ষকতা ছিল তার পেশা কিন্তু লেখা হচ্ছে তার শক্তিশালী হাতিয়ার। ১৯৬৪ সালে ‘অন্বেষা’ নামের বই প্রকাশ করে যে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তা অব্যাহত থাকুক। কলমকে হাতিয়ার করে লড়াই এবং সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করুন তিনি আরও বহুদিন। জন্মদিনে এ আমাদের একান্ত কামনা।