বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে এক দিনই মাত্র দেখা হয়েছিল। মারুত (কবি অদ্বৈত মারুত) ভাইয়ের সঙ্গে ‘দৈনিক আমাদের সময়’-এর অফিসে। ঈদসংখ্যার বিল নিতে গেছেন। আমিও। সম্ভবত ঘণ্টাখানেকের আড্ডা। এই ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যেই মানুষটা কী করে যেন আপন হয়ে উঠলেন। একেবারে নিজের মানুষ হয়ে উঠলেন। দেখলাম, একেবারে ভণিতাহীন একজন মানুষ। কোনো রাখঢাক নেই। মনে যা, মুখেও তাই। কথায় কথায় ধ্রুবদার লেখা ‘পরেশের বউ’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ তুললাম। সেখানে চৌধুরী নামে একটা ক্যারেক্টার আছে। আগেই জেনেছিলাম সেই চৌধুরী চরিত্রের সঙ্গে এই বুলবুল চৌধুরীর কোনো এক গোপন সম্বন্ধ আছে। ‘ঠাকুর ডুবানোর’ কথা তুলতেই মুখে লাজুক হাসি হেসে আরও আরও গল্পের আলপথ ধরে হাতের মুঠোয় ধরা তামাকে আরও একটু জোরে ডলা দিতে শুরু করলেন।
তাতে অগ্নিসূচনার পরে সমস্ত রহস্য আরও ঘনীভূত করে দিয়ে দেখলাম বুলবুল ভাই সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর ভেতর থেকে আহ্বান করছেন, ‘টান দিবেন নাকি?’
ফোন নম্বর বিনিময় করে আমরা ফিরে আসি যার যার গন্তব্যে। বুলবুল ভাইকে তারপর ফোন করা হয়নি অনেক দিন। যদি না চেনেন? মাত্র ঘণ্টাখানেক আড্ডার বন্ধুকে কে আর মনে রাখে! তার ওপর তিনি বুলবুল চৌধুরী। শহরের সফেদ ধোঁয়ার মানুষ। ফলে আমার অন্তর্জাগতিক সীমাবদ্ধতাকে আর অতিক্রম করা হয়নি।
সেবার তাঁর জন্মদিন। শিল্পী কামরুল মিথুন বুলবুল ভাইকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ‘ধোঁয়ার অন্তর্গত মানুষ’ শিরোনামে একটা মিউজিক ভিডিও। বুলবুল ভাইকে ফোন করলাম। নিজের পরিচয় দিতেই চিরায়ত ঢঙে বললেন, ‘তোমারে তো চিনছি মিঞা! পরিচয় দেওনের কিছু নাই।’
খেয়াল করলাম আপনি থেকে তুমিতে এসেছি। তবে কি আমিও তাঁর হৃদয়ে জায়গা পেয়েছি? সামান্য হলেও? সেদিন বিকেলে জন্মদিন উপলক্ষে সম্ভবত কোনো একটা আয়োজন ছিল। বিকেলে যেতে বললেন। সৌজন্য কথাবার্তা শেষ করে আমরা ফোন রেখে দিই।
তারপর আরও কয়েকবার কথা হয়েছে ফোনে। খুব যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তেমন না। মানুষটাকে আমার ভালো লাগত। কেন লাগত ব্যাখ্যা করে বলা মুশকিল। ভালো লাগাগুলো সম্ভবত এমনই। ব্যাখ্যাতীত।
একদিন দুপুরে কে যেন বলল, বুলবুল চৌধুরী মারা গেছেন। শুনে হতভম্বের মতো নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম মুহূর্তের জন্য। মৃত্যু অমোঘ, তা জানি। কিন্তু আমাদের প্রিয় মানুষগুলোর মৃত্যুর বেলায় এই সত্যকে আমরা অগ্রাহ্য করতে পারলে বেঁচে যাই। সেদিন সেই সংবাদ শুনে তাঁর নাম্বারে আর ফোন করার সাহস হয়নি। কামরুল মিথুনকে ফেসবুকে নক দিয়ে ঘটনার সত্যতা জানতে চাই। মিথুন একটু পরে জানায় বুলবুল ভাই ঠিক আছে। সংবাদটা সত্য নয়। একটু আগেই নাকি মিথুন বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন।
শেষ দিকে আমি আক্ষরিক অর্থেই বুলবুল ভাইকে ফোন করতাম না। করতাম না, কারণ ক্যানসার আক্রান্ত প্রতিটি মুখেই আমি আমার মায়ের মুখটা তাঁর যন্ত্রণাসমেত দেখতে পাই। আমি নিতে পারি না এই দৃশ্য।
ফলে দূর থেকে বুলবুল ভাইয়ের জন্য প্রার্থনা করলেও কখনো আর তার সঙ্গে দেখা করা হয়নি। কথাও হয়নি।
আজ তিনি চলে গেলেন। আমি ভাবছি এই শহর, এই আড্ডা, জীবনকে তুড়িতে উড়িয়ে দেওয়ার দুঃসাহস ফেলে তিনি কি সেখানে থাকতে পারবেন? আর এ শহরের তাঁর আড্ডার বন্ধুগুলো? আমি নিশ্চিত ধ্রুবদার আড্ডায় একটি আসন এরপর থেকে সব সময় ফাঁকা থাকবে। ওখানে কারো বসা নিষেধ। সেই আসনটি বুলবুল চৌধুরীর।
২.
এই লেখাটি লিখতে লিখতেই খবর পেলাম রম্যলেখক আতাউর রহমান আর নেই। তিনিও আজকেই চলে গেলেন। দুপুরে গেছেন শেখ আবদুল হাকিম।
এই সংবাদগুলো সত্যিই আর নিতে পারছি না। হাকিম ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়নি কখনো। কিন্তু আতাউর রহমান! তিনি তো ফোন করেই, ‘মিস্টার সাহা, কেমন আছেন?’ বলেই মজার মজার জোকস দিয়ে শুরু করে মূল প্রসঙ্গে যেতেন। বয়স ৮০-এর কাছাকাছি কিন্তু দেখে মনে হতো ৬৫-৭০। এই ১০ বছরে বোঝা তিনি কমিয়েছিলন তার রুটিনমাফিক জীবনযাপনের মাধ্যমে। প্রশাসনের বড় বড় পদে চাকরি করার ফলেই হোক কিংবা জেনেটিক কোনো কারণেই হোক, বরাবরই দেখেছি তিনি খুবই নিয়ম মেনে চলতেন। তার পাণ্ডুলিপিতেও দেখেছি সেই যত্নের ছাপ। চেষ্টা করতেন নিখুঁত করে সাজাবার। ডাক বিভাগের সাবেক এই মহাপরিচালক ছিলেন আদ্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও রসিক মানুষ।
শেখ আবদুল হাকিম, বুলবুল চৌধুরী ও আতাউর রাহমান— বিশিষ্ট এই তিন কথাশিল্পীর আত্মার শান্তি কামনা করি।