আমার জীবনে চুয়াত্তরের একটি রৌদ্রকরোজ্জ্বল বিকেলের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
সেই বিকেলের গল্পটিই আমার জীবনের সবচে গৌরবের গল্প। লেখক গবেষক শামসুজ্জামান খানের পরামর্শে আমি একটি বই লেখায় হাত দিয়েছিলাম। লেখাটা শেষ করে এনেছি প্রায়। বইমেলায় হয়তো বেরুবে বইটা। প্রথমে বইটির নাম দিয়েছিলাম, ‘আমার শৈশব আমার বঙ্গবন্ধু’। কিন্তু পুরো পাণ্ডুলিপিটা তৈরি হতে হতে বইয়ের নামটা গেছে পালটে। নামটা এখন, ‘আমার শৈশব আমার যৌবন আমার বঙ্গবন্ধু’। আমার জীবনের গতি-প্রকৃতি পাল্টে দিতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার দেখা হবার বিস্ময়কর সেই বিকেলের বিশাল একটা ভূমিকা রয়েছে।
২.
সেই বিকেলে আমাদের নিজস্ব কিছু আনুষ্ঠানিকতাও ছিল। আমার নেতৃত্বে মার্চপাস্ট হলো। মার্চপাস্টে ছেলেমেয়েদের স্যালুট গ্রহণ করলেন বঙ্গবন্ধু। মার্চপাস্টের শুরুতে ছোট্ট এইটুকুন আমি বিশাল দেহের বঙ্গবন্ধুর মাথায় পরিয়ে দিলাম কচি-কাঁচার মেলার ক্যাপ। খুব নিচু হয়ে মাথাটা আমার নাগালের কাছে নামিয়ে এনে বিরাট-বিশাল বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন আমার মতো একজন খুদে বন্ধুর স্মারক উপহার। বঙ্গবন্ধুর মাথা এবং মাথার চুল স্পর্শ করতে হলো আমাকে, ক্যাপটা তাঁকে পরাতে গিয়ে। তাঁর শক্ত এবং ঘন কালো চুলগুলো ভীষণ ঠান্ডা ছিল। আমাদের কাছে আসবার আগ পর্যন্ত সারাটা দিন একটানা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ছিলেন বলেই কি তাঁর সতেজ ঘন চুলগুলো এতো শীতল লাগছিল আমার কাছে! কী জানি!
ক্যাপটা পরানোর পর বঙ্গবন্ধু হ্যান্ডশেক করলেন আমার সঙ্গে। আহা কী নরোম তাঁর হাতটা! তারপর তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত তর্জনীটি, একাত্তরের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অবিস্মরণীয় সেই আঙুলটি আমার দিকে তাক করে খুবই হাস্যোজ্জ্বল ভঙ্গিতে বললেন, “আরে এই ছেলেটাকে তো মনে হয় চিনি আমি!”
আমি আমার ছোট্ট দু’টি হাত দিয়ে তাঁর হাতটা জড়িয়ে ধরলাম, “হ্যাঁ চেনেন তো! আমি রিটন। ছবি আঁকি। আমাদের আঁকা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম তো! দুই বছর আগে।”
বঙ্গবন্ধু বললেন, “আরে তাই তো, এইটাই তো সেই আর্টিস্ট ছেলেটা। খুব সুন্দর ছবি আঁকে “
হাসিমুখে দাদাভাই বললেন, “আমাদের রিটন ছড়াও লেখে! ইত্তেফাকে ওর ছড়া ছাপাও হয়েছে!
শুনে বঙ্গবন্ধু একটু অবাক হবার ভঙ্গি করে বললেন, “তাই নাকি? তুমি তাহলে কবি হবা বড় হয়ে! সুফিয়া কামালের মতো? জসিমউদ্দিনের মতো?”
আমি না সূচক মাথা নাড়াই, “না বঙ্গবন্ধু, আমি কবি হবো না।”
বঙ্গবন্ধু বললেন, “তাহলে তুমি হবা ছড়াকার।”
এবারও রাজি হই না আমি। মাথা নেড়ে অসম্মতি জানাই। আমার কাণ্ড দেখে দাদাভাই আর খালাম্মা সুফিয়া কামাল হাসতে থাকেন। আমার কথায় মজা পেয়ে হাত তালি দিতে থাকেন সুফিয়া কামাল।
এবার বঙ্গবন্ধু বললেন, “তাহলে বড় হয়ে কী হবা তুমি?”
খুব স্মার্ট ভঙ্গিতে বললাম আমি, “আর্টিস্ট হবো।”
—কতো বড় আর্টিস্ট হবা?
—জয়নুল আবেদীনের মতো বড় আর্টিস্ট হবো বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু বললেন, “বাহ্ আমাদের তাহলে দুইটা জয়নুল আবেদীন হবে!”
আমাদের কথোপকথনের সময় পাশে থাকা কবি সুফিয়া কামাল আর রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই খুব হাসছিলেন। আসলে ছেলেবেলা থেকেই খুব চটপটে আর ছটফটে ছিলাম আমি। বড়দের সঙ্গে কথা বলতে একটুও ভয় পেতাম না। ভয় পাইনি বঙ্গবন্ধুকেও। আর বঙ্গবন্ধু আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছিলেন যে আমাকে তিনি অনেক আগে থেকেই চেনেন!
আমার মাথায় কাঁধে গালে আর চিবুকে আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে আদর করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার এই অপরূপ কথোপকথন আমার একজীবনের শ্রেষ্ঠ সংলাপের স্মৃতি হয়ে থাকলো। এই সৌভাগ্যের কথা এই পরম প্রাপ্তির কথা আমি গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করে যাবো নতুন প্রজন্মের কাছে। সেই বিকেলটা, সেই মুহূর্তগুলো, তাঁর কণ্ঠস্বর, তাঁকে ছুঁয়ে দেয়া, এবং তাঁর অনন্য আশীর্বাদমাখা স্নেহস্পর্শ পাওয়ার সেই অমূল্য ঘটনাটা এখনো আমার কাছে অলৌকিক কোনো রূপকথা বলেই মনে হয়! ইতিহাসে এরকম মুহূর্ত একবারই আসে।
৩.
সেই বিকেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন আমার দেখা হয় তখন তো আমার স্বপ্ন ছিল পেইন্টার অর্থাৎ চিত্রশিল্পী হওয়ার। কিন্তু নিয়তি বা প্রকৃতি চাইছিল ভিন্ন কিছু। তিনি যখন আমার মাথায় চুলে গালে কপালে কাঁধে চিবুকে স্পর্শ করে করে আদর করে দিচ্ছিলেন তখনই আসলে ঘটে যাচ্ছে অদ্ভুত একটা শিহরণ। বিপুল একটা আলোড়ন। বঙ্গবন্ধুর মতো বিরাট বিশাল হিমালয়সম মানুষটার অলৌকিক সান্নিধ্য আমার ভেতরে কিছু একটা ওলট-পালট তো ঘটিয়েই থাকবে। কিন্তু সেটা বোঝার মতো বয়েস তখন আমার ছিল না। আমি বুঝিওনি। কিন্তু তিনি তো ছিলেন পরশ পাথরের মতো! তাঁর অবিনাশী স্পর্শের জাদুতে নিয়তি বা প্রকৃতি তখনই সিদ্ধান্তটা পাঁকাপাঁকাকি করে ফেলেছিল যে, বড় হয়ে আমাকে হতে হবে লেখক। হতে হবে কবি। এবং আমার লেখার বিষয় হবেন এই বঙ্গবন্ধু। এবং পরবর্তী সারাটা জীবন আমাকে লিখে যেতে হবে ছড়া কিংবা কবিতা, একের পর এক, তাঁকে নিয়ে। ধারাবাহিকভাবে আমাকে লিখতে হবে বই, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। একের পর এক। একটা বই দুটো বই। সাতটা আটটা দশটা বই।
আমি যখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখি তখন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। কেমন একটা স্বপ্ন-বাস্তবতার মাঝামাঝি জায়গায় থাকি। যেন আমি লিখি না। আমি লিখছি না। প্রকৃতিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে যেন বা!
শৈশবে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যস্মৃতি আমার মনোজগতে চিরস্থায়ী একটা ছাপ ফেলে দিয়েছিল। তাঁর স্পর্শের সৌরভ আর সান্নিধ্যের গৌরব দীপান্বিত করেছিল আমাকে। সেই বৈভব আমি বহন করে চলেছি আজও। আমার করোটির চিরহরিৎ অলিন্দে থাকা, হৃদয়ের গভীর গোপন কুঠুরিতে থাকা একজন মুজিব প্রায়শই ছন্দ হয়ে হাসেন এবং ছড়া হয়ে আসেন। প্রকৃতি এক অদ্ভুত খেলা খেলে আমার সঙ্গে। একটা ঘোরের মধ্যে ফেলে যেন-বা প্রকৃতিই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় শেখ মুজিবের ছড়া। একের পর এক। আর সেটা মুদ্রিত হয় আমার নামে, লুৎফর রহমান রিটনের নামে—‘কান পেতে শোনো এই বাংলার মাটি বায়ু নদী সরোবর/জপিতেছে নাম করিয়া প্রণাম মুজিবর আহা মুজিবর...।’
৪.
কবি সুনীল গঙ্গোপধ্যায় তাঁর একটি প্রেমের কবিতায় বলেছিলেন—
‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?’
সুনীলের সেই কবিতার পঙ্ক্তির মতো আমিও বলতে পারি দ্বিধাহীন চিত্তে—
বিরাট বিশাল অভ্রভেদী বঙ্গবন্ধু তাঁর চিরউন্নত শির
তিনি একবার নামিয়ে এনেছিলেন বালক আমার হাতের নাগালে,
অবলীলায় আমি ছুঁয়েছি তাঁর সাতই মার্চের অমর সেই তর্জনীটি।
যেই তর্জনীর ঐতিহাসিক হেলনেই নির্মিত হয়েছিল
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নিজস্ব ঠিকানা।
অতঃপর অলৌকিক সেই বিকেলে
বঙ্গবন্ধুর হাত ছুঁয়েছে আমার কপোল-চিবুক,
স্পর্শ করেছে আমার কাঁধ,
তাঁর জাদুকরী আশীর্বাদের হাতটি তিনি রেখেছিলেন
অপাপবিদ্ধ বালক আমার ছোট্ট এইটুকুন মাথায়,
বঙ্গবন্ধুর অলৌকিক স্পর্শ লাগা আমার শরীর-মন-মেধা-মনন কি
বাংলা-বাঙালি-বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশবিরোধী কোনো পাপ করতে পারে?