স্বাধীনতা পদক নিয়ে বিতর্ক

স্বকৃত নোমান প্রকাশিত: মার্চ ১৬, ২০২২, ১০:১৮ এএম

এই ব্যাপারে আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, এবার স্বাধীনতা পদকের জন্য মহান বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিমের নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে এ পদক দেওয়া হয়নি। বারবার তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, অথচ তিনি উপেক্ষার শিকার হচ্ছেন। তাঁর বিষয়ে পরে বলছি। আরেক প্রখ্যাত বাউলশিল্পী দূরবীন শাহের ব্যাপারেও পরে বলছি।

আগে বলি, রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দেওয়া কেন? এই জন্য যে, যাঁরা নানা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন, নিজ নিজ কর্ম দিয়ে যাঁরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদের কাজের স্বীকৃতি হিসেবে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার জন্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার দিতে হয়। ভালো কাজের স্বীকৃতি দেওয়া না হলে মেধার বিকাশ ঘটে না, সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটে না, পরবর্তী প্রজন্ম ভালো কাজের প্রতি উৎসাহিত হয় না। 

স্বাধীনতা পুরস্কার বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার। এই পুরস্কার তাঁদেরই দেওয়ার কথা, যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ নানা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। স্বীয় কর্মের মধ্য দিয়ে গোটা জাতি না হলেও জাতির একটা বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন এবার স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হচ্ছে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেনকে, যিনি বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধের স্থপতি। স্মৃতিসৌধ একটি জাতির প্রতীক। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর অতিবাহিত হয়ে গেল, পঞ্চাশ বছরে এই প্রতীকের স্থপতিকে এই রাষ্ট্র পুরস্কৃত করতে পারেনি। এই লজ্জা ঢাকার মতো কোনো বস্ত্র নেই, কোনো কম্বল নেই, কোনো দেওয়াল নেই। পঞ্চাশ বছর পর সেই লজ্জা কিছুটা হলেও ঢাকা গেল।

এবার সাহিত্যে ‘বিশেষ অবদানে’র জন্য স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হচ্ছে মো. আমির হামজাকে। আমির হামজা কে? যাঁরা এই দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা প্রয়াত আমির হামজার নাম জানেন না, আগে কখনো তাঁর নাম শোনেননি। কে তিনি? তিনি ছিলেন একজন পালাকার, গীতিকার। মুখে মুখে গান রচনা করতেন এবং সেসব গান নানা আসরে পরিবেশন করতেন। রাজনীতি, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে গান লিখেছেন। তাঁর গানের সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।

কিন্তু তিনি কি সাহিত্য ক্যাটাগরিতে স্বাধীনতা পদক পাওয়ার যোগ্য? আমি মনে করি না যোগ্য। সাহিত্য ও সংস্কৃতি দুটি আলাদা বিষয়। গান যতটা না সাহিত্য, তার চেয়ে বেশি সংস্কৃতিভূক্ত। তাকে পুরস্কৃত করতে হলে সংস্কৃতিতে কিংবা সংগীতে অবদানের জন্য পুরস্কৃত করা যেতে পারত। এখন নিশ্চয়ই কেউ কেউ এ প্রশ্ন তুলবেন, বব ডিলানকে বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যদি গানের জন্য নোবেল প্রাইজ দেওয়া যেতে পারে, গীতিকবি মো. আমির হামজাকে নয় কেন? এমন প্রশ্ন ফেসবুকে আজ দেখেছিও।

আচ্ছা, মেনে নিলাম গানও সাহিত্যের অংশ। মেনে নিলাম সাহিত্যের কোনো জনরা নেই। মেনে নিলাম, যিনি বিশিষ্ট নাট্যকার, তাঁকে ঔপন্যাসিক হিসেবে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। মেনে নিলাম, যিনি বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী, তাঁকে চিত্রশিল্পে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। মেনে নিলাম, যিনি বিশিষ্ট কবি, তাঁকে গল্পকার হিসেবে পুরস্কৃত করা যেতে পারে। মেনে নিলাম। সবই মেনে নিলাম।

তবে একটা প্রশ্ন আছে। আপনারা যে, ‘গীতাঞ্জলি’র শিল্পমান কিংবা বব ডিলানের গানের শিল্পমানের সঙ্গে মো. আমির হামজার গানকে সমপর্যায়ে তুলে দিলেন বা দিচ্ছেন, আপনারা কি আমির হামজার কোনো গান শুনেছেন? অধিকাংশই শোনেননি। পড়েছেন? অধিকাংশই পড়েননি। না পড়ে কেন আমির হামজার পক্ষাবলম্বন? কারণ, প্রবাদ, ‘ভাইয়ে কইছে বানতে ধান/বানতে আছে ওদা ধান।’ 

আর, আমির হামজার গান কি বাঙালি জাতির বৃহত্তর অংশকে প্রভাবিত করেছে? নাড়া দিতে পেরেছে? উত্তর, না। শিল্পের মান বিচারে তাঁর গান কি উচ্চতর? উত্তর, না। অন্তত আমার কাছে উচ্চতর মনে হয়নি। জানি, শিল্পের ভালো-মন্দ আপেক্ষিক। আমার কাছে যা দুর্বল, অন্যের কাছে তা সবল। অন্যের কাছে যা সবল, আমার কাছে তা দুর্বল। আচ্ছা, মেনে নিলাম আমির হামজার গান উচ্চতর শিল্পমানসম্পন্ন। কিন্তু প্রশ্ন, স্বাধীনতা পদক পাওয়ার মতো তাঁর চেয়ে অধিকতর যোগ্যতা সম্পন্ন কেউ কি নেই আমাদের দেশে? কেউ কি ছিলেন না?

বাউলশিল্পী শাহ আবদুল করিম গানের মধ্য দিয়ে গোটা জাতিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছেন, কীভাবে আন্দোলিত করেছেন, তা আমার বলার দরকার নেই, সবাই জানেন। তাঁর গান ছাড়া এই দেশের কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় না। হেন বাঙালি নেই, যে তাঁর গান শোনেনি। তাঁকে বাদ দিয়ে বাংলা গানের ইতিহাস লেখা যাবে না। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক। গানের মধ্য দিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছিলেন। স্বাধীনতার মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়েও তিনি গান রচনা করেছেন, গেয়েছেন। তাঁকে কি স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে? হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখুন, এবার সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করার জন্য নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু উপেক্ষিত হয়েছে সেই প্রস্তাব। লজ্জা হয় না আপনাদের? একটুও লজ্জা হয় না? 

গীতিকবি দূরবীন শাহ ছিলেন একজন শব্দসৈনিক। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান কম নয়। তিনিও মুক্তিযুদ্ধের শব্দসৈনিক। গানের মধ্য দিয়ে তিনি গোটা বাঙালি জাতিকে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখনো তাঁর গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে, ফিরবে আরও বহু কাল। তাঁকে কি স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে? হয়নি। নানা মহল থেকে একাধিকবার তাঁর নাম প্রস্তাব করা হয়েছে, অথচ বারবারই তাঁর নাম উপেক্ষিত হয়েছে। মহান গীতিকবি বিজয় সরকার, গানের মধ্য দিয়ে যিনি একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁকে কি স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়েছে? হয়নি। লজ্জা হয় না আপনাদের? একটুও লজ্জা হয় না? জীবিত পালাকার, লোকদার্শনিক সাঈদুর রহমান বয়াতিকে কি স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে? হয়নি। এমন অসংখ্য লোককবি, পালাকার, গায়েন গীতিকারের নাম দেওয়া যাবে, যাঁরা স্বাধীনতা পদকের যোগ্য, অথচ উপেক্ষিত হচ্ছেন।

পালাকার, গায়েন, গীতিকারগণের কথা থাক। এবার বলি অন্যদের কথা। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্’র অবদান কী, তা আমার বলে দেওয়ার দরকার নেই। এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী মাত্রই তাঁর নাম জানেন, তাঁর গল্প-উপন্যাস পড়েছেন, পড়ছেন। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে তিনি জনমত তৈরির চেষ্টা করেছেন, সঙ্গতিতে যতটুকু কুলিয়েছে সেই অনুযায়ী তিনি টাকা পাঠিয়েছেন কলকাতায় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্কে কি স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে? হয়নি। বাংলা ভাষার শক্তিমান কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে কি স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে? কিংবা কথাশিল্পী শওকত আলীকে? না, দেওয়া হয়নি।

সেলিম আল দীন, বাংলা নাটকের ধারাকেই যিনি পাল্টে দিয়েছেন, তাঁকে কি স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়েছে? হয়নি। ভাষাসৈনিক আহমদ রফিক, সংস্কৃতিসাধক সনজীদা খাতুনকে দেওয়া হয়েছে? হয়নি। তালিকা অনেক লম্বা। সবার নাম বলে শেষ করা যাবে না। 

সাহিত্য-সংস্কৃতির এই মহীরূহদের বাদ দিয়ে, দিনের পর দিন উপেক্ষা করে রইজ উদ্দিন (পরে বাতিল) কিংবা মো. আমির হামজাকে যখন একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, তখন আমাদের খেদ তৈরি হয়, ক্ষোভ তৈরি হয়, ক্লেদ তৈরি হয়। 

একটা দেশের গুরুত্বপূর্ণ আসনে যখন গৌণরা অধিষ্ঠিত হয়, যখন তারা সামনের কাতারে চলে আসে, নেতৃত্বে চলে আসে এবং মুখ্যরা পেছনে পড়ে থাকে; যখন মহীরুহগণ উপেক্ষিত হতে থাকেন, গৌণরা গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি পেতে থাকেন এবং একটা দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির ভালো-মন্দ যখন আমলারা ঠিক করে দেন, তখন এটাকে অশনি সংকেত হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। বুঝতে হবে দুর্যোগ আসন্ন।