প্রমিথিউসের অন্ধ আশাবাদ 

সায়মা খাতুন প্রকাশিত: জুলাই ২৬, ২০২১, ১০:১৯ এএম

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের আগে কেউ আমার কথা মন দিয়ে শোনেনি।  ১৯৮৯ সালে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের সাথে যখন প্রথম দেখা হয়, আমার প্রথম স্মৃতি হল, সদ্য স্কুল পাশ করা একটা বাচ্চা মেয়ের কথা কেউ কখনও মনোযোগ দিয়ে শুনছে। শুধু শুনছেই না, এমনভাবে শুনছে, যেন সমকক্ষ একজন বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মানুষ আরেকজন বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন মানুষের আলাপ হচ্ছে (এই অনুভূতিটা আমি ঢাকা শহরে আরেকজন মনীষার কাছে পেয়েছিলাম, তিনি হলেন সলিমুল্লাহ খান)। অনুজ, অল্পবয়েসীদের সাথে সমকক্ষতার পাটাতনে ঢাকাতে আলাপ করেন এমন মানুষ হাতে গোনা।

এহেন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে পরিণত জীবনে এসে আমি পলিটিকালি  ইনকারেক্ট মনে করি। শ্রেণি, লিঙ্গ, বর্ণ, জাতি, জাতীয়তাবাদ— এই সব কিছু নিয়েই তার বক্তব্য উচ্চবর্গীয় এলিট শ্রেণির অবস্থান থেকে বিচার করা। যদিও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি—আমি যতদূর দেখেছি—একজন আত্মত্যাগী, পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ, সৎ মানুষ। আজকাল আমি বিত্তবাসনাহীন এমন আর কারো কথা মনে করতে পারি না। আবু সায়ীদের চিন্তার জগতে আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের একটা কলোনিয়াল আদর্শ তাঁকে সম্পূর্ণ অভিভূত করে রেখেছে। ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁ’র একটা ভাবধারায় বাঙালি মধ্যবিত্ত পুরুষকেন্দ্রিক আধুনিক শিক্ষার  হেজেমনি উৎপাদনের কাজটিকে তিনি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছেন, কিম্বা বুঝতে চেষ্টা করেননি। আমার জন্যে অন্তত নৃবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও পদ্ধতির আলোকে তাঁর আলোকিত মানুষের গোটা ভাব-আন্দোলনকেই রাজনৈতিকভাবে ভুল বলে মনে হয়। সমাজতন্ত্রী ভাবনার বিচারে শ্রমিক- কৃষক, চাষা-মুটে-মজুরদের শ্রেণি সংগ্রামের সাথে এই আলোকিত মানুষের আন্দোলন বিচ্ছিন্ন। নিম্নবর্গীয় চৈতন্যের অস্তিত্বের নড়াচড়াকে, বিপুল বিস্তারকে এখান থেকে ধরা অসম্ভব। 

নারীবাদীদের কাছে তাঁর সাহিত্য বিচার— নারীত্ব, পৌরুষের ধারনা, প্রেম, বিয়ে ও পরিবারের ভাবনা— ভীষণভাবে সমস্যাজনক। এমনকি তাঁর বিখ্যাত রসিকতাগুলোও ভীষণ আপত্তিকর। বিশেষ করে সর্বশেষ ‘শাড়ি’ বিষয়ক লেখাটি তাঁর রচনাসমগ্রের মধ্যে সবচেয়ে পলিটিকালি ইনকারেক্ট। অনেক বছর তাঁর লেখা পড়ার সময়সুযোগ পাই নাই। শাড়ি বিতর্কের সময় আমার অনেক সমাজতন্ত্রী, কৃষক-শ্রমিকের শোষণ মুক্তির লড়াইয়ে লড়াকু কমরেড, নারীবাদী বন্ধুরা আমাকে আরও কিছু লেখা পাঠিয়েছেন, যেগুলো পড়ে মনে হয়েছে, এই রচনাগুলো সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য, এগুলো না থাকলেই ভাল হত। 

নৃবিজ্ঞান, সমাজবাদ, এবং নারীবাদ— চিন্তার অন্তত তিনটি বিচার পদ্ধতির সাথে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের আলোকায়নের সামাজিক ও সাহিত্যিক চিন্তা পদ্ধতি এবং আন্দোলন সাংঘর্ষিক। ফলে, নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সাথে অধ্যাপক সায়ীদের পথে মেলার আর সুযোগ থাকে না। 

কিন্তু যখন নিজের জীবন এবং গড়ে ওঠার দিকে ফিরে তাকাই, তখন দেখি, গ্রীক মিথোলজির প্রমিথিউসের অন্ধ আশাবাদের চাষাবাদ ছাড়া যে জীবনকে আমি দেখতে পেয়েছি, সেই জীবন কেমন করে দেখতে পেতাম? সক্রেটিসের জবানবন্দী, প্লেটোর সংলাপে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াই কেমন আলাপ-সংলাপ দিয়ে, যুক্তি-তর্ক-বুদ্ধি দিয়ে, অহিংসা দিয়ে, জীবন উৎসর্গ করে করা যেতে পারে। জীবনকে এমন তুলাধুনা করে, ধোপার পাটে আছড়ে, পতন ও উত্থানে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এক প্রচণ্ড রকম বেঁচে থাকা কেমন করে শিখতাম? নব্বইয়ের দশকে ১৬ বছর বয়েসে যখন এই অধ্যাপকের দর্শন ও সান্নিধ্য লাভ করি, মোটামুটি বছর পাঁচেক  তাঁর পরিকল্পনায় এবং পরিচালনায় বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে আমি অংশগ্রহণ করেছি । ওই পাঁচ বছরে আমি আমার মত অনেক ছেলেমেয়ের সাথে বাংলা ভাষা এবং বিশ্বসাহিত্যের ক্লাসিক ধারার প্রধান লেখালেখিগুলো পড়ে ফেলেছি। এখনও অবিশ্বাস্য লাগে যে, মাত্র ১৬-২১ বছর বয়েসে প্রাচীন গ্রীক সাহিত্যের সক্রেটিস, প্লেটো, আরিস্তেতল, হোমার, সফোক্লিস, আরিস্তফানিস, ইউরিপিদিসের অনুবাদ, রাশিয়ান সাহিত্যের তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, মাক্সিম গোর্কি, চেখভ, নিকলাই গোগল, নিকলাই অস্ত্রভস্কি, বরিস পাস্তারনাক পড়ে ফেলেছিলাম, ফরাসী সাহিত্যের ভলতেয়ার, বোদলেয়ার, আলবেয়ার কামু, জা পল সার্ত, বোভায়া,ভিক্টর হুগো, গুস্তাভ ফ্লভেয়ার, মোপাসা। পড়েছিলাম, মার্ক টোয়েন, চার্লস ডিকেন্স, জ্যাক লন্ডন, জর্জ বার্নার্ড শ, সামারসেট মম। বাংলার সাহিত্যের প্রেমে মজেছিলাম, আলাওল, বিদ্যাপতি থেকে পড়েছিলাম। রামায়ণ, মহাভারত, ময়মসিংহ গীতিকার রসে ভজেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের প্রধান রচনাগুলো পড়ে ফেলেছিলাম। জীবনানন্দ, তিরিশের পাঁচ কবি, থেকে জসীম উদ্দিন, ষাটের দশকের মাহমুদুল হক, আবুল হাসান, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মহাশ্বেতা দেবী থেকে মামুন হোসাইন, রুদ্র মহাম্মদ শহিদুল্লাহর সাথে গভীর প্রণয় ঘটে যায়। মনে আছে, ঠিক সেই সময়েই তসলিমা নাসরিনের নির্বাচিত কলাম প্রকাশ শুরু হয়ে আমাদের তোলপাড় করে তোলে। নীলিমা ইব্রাহীমের ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’র খণ্ডগুলোও আমাদের হাতে আসে। সেসব নিয়ে আমরা উত্তেজিত হয়েছিলাম। অনেক লেখা সায়ীদ স্যার নিজে থেকে আলাপ করতেন আর আমাদের আলাপে উস্কে দিতেন। সে ছিল এক মাতোয়ারা হওয়ার যুগ। তারপর অনেক বছর হয়, সেই সব তরুণ বন্ধুরা বিভিন্ন পথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। কেউ স্থিতাবস্থার মধ্যে রয়ে গেছে, কেউ সমাজ বদলের রাজনীতিতে ঢুকেছে, কেউ লিখেছে, কেউ লেখেনি। 

সায়ীদ স্যারের জীবনের অনেক মুহূর্তকে তাঁর finest hours বলা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ ১৩, ১৪, ১৫, ১৬, ১৮, ১৯, বছরের বাচ্চাদের মনের জগতকে নিয়ে ভাবার জন্যে গত তিরিশ বছরেও খুব বেশী কাউকে দেখতে পাই নাই। বাংলাদেশে কিশোর-তরুণদের বাংলা ভাষায় গদ্যে-পদ্যে লেখার কলাকৌশল হাতে কলমে বিনা পয়সায় শেখানোর জন্যে জীবন ব্যয় করবার মত পাগল আর কেউ আছে কিনা জানি না। জাতি যে বইপড়ার বিরুদ্ধে বাঘে-গরুতে একজোট, সেটা তরুণদের আর তাদের হর্তাকর্তাদের, নেতাদের, বড় ভাইদের, ইনফ্লুয়েন্সারদের আলাপ থেকে স্পষ্ট। সাহিত্য, ক্লাসিক ইত্যাদি উচ্চবর্গীয় ও পরিত্যাজ্য! ওদিকে  নিম্নবর্গীয় সাহিত্য ও চৈতন্যের আন্দোলন গড়ে তুলবার কাজটি যে কে কোথায় করছে তাও ঠাহর করা মুস্কিল। 

বাংলা মটরে আব্দুল্লাহ আবু সাঈদের ৫০তম জন্মদিনের দিন উদযাপনের আনন্দ আড্ডার কথা স্পষ্ট মনে আছে। মাতৃগর্ভ থেকে নেমে পিতার হাত ধরে পৃথিবীর পথে চলবার সময়, পৃথিবীর পাঠশালায় দীক্ষা নেয়ার সময় কিছু অতিকায় দানবদের দেখা পেয়েছিলাম। এই অতিকায় দানবদের কাঁধের উপর দাঁড়াতে পেরে আমি যা দেখতে পেয়েছি, আমি যা করতে পেরেছি, আমি যা হতে পেরেছি, তার পরিমাপ করা অসম্ভব। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সেই দানবদের একজন, যিনি ১৬ বছরের নাম না জানা এক তুচ্ছ মেয়ের কথা শুনেছিলেন, তার বুদ্ধিবৃত্তিকে সক্রেতিস, তলস্তয়, বোভায়া, রোকেয়ার মতই স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, চিরজীবনের জন্যে স্থির আত্মবিশ্বাস মনের গভীরে বুনে দিয়েছিলেন, প্রমিথিউসের অন্ধ আশাবাদ রক্তে মিশিয়ে দিয়েছিলেন। আজ তাঁর  ৮২ তম জন্মদিনে যদি এই কথা না বলি, তবে আর কবে বলবো?

ফেসবুক থেকে।