তেলের অসময়োচিত মূল্যবৃদ্ধি, বাসমালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা

সাইফুর রহমান তপন প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২১, ০৩:৩৮ পিএম

ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধির পর পরিবহন খাতে যা ঘটল, তা সত্যিই নজিরবিহীন। বলা নেই কওয়া নেই হুট করে, ট্রেন ও বিমান বাদে, সব পরিবহন বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তা থেকে বাস-ট্রাক উধাও। নদী থেকেও হাওয়া গেল লঞ্চ-স্টিমার। সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল বুধবার রাতে, বৃহস্পতিবার থেকেই দেখা গেল পরিবহনমালিকদের এ তেলেসমাতি কাণ্ড।

এদিকে শুক্রবার-শনিবার ছিল সরকারি বিভিন্ন সংস্থার নিয়োগ পরীক্ষা। সে উপলক্ষে কয়েক লাখ চাকরিপ্রার্থী ঢাকায় এলেন। ঢাকার চাকরিপ্রার্থীরাসহ এই লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ও তাদের অভিভাবকেরা এ অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘটে ভীষণ ঝামেলায় পড়লেন। খুব স্বাভাবিকভাবেই রিকশা-সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন প্রাইভেট হালকা পরিবহন এর সুযোগ নিল। ফল হলো যে দূরত্ব যেতে আগে খরচ হতো একশ টাকা, সেখানে খরচ পড়ল অন্তত পাঁচশ টাকা।

এই ভাড়া দিয়েও বহু যাত্রী কোনো পরিবহন পায়নি। তাদের চলতে হয়েছে পায়ে হেঁটে। সব মিলিয়ে ভীষণ এক ভোগান্তি, যার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না।

সরকার হয়তো ভেবেছে, ১৫ টাকা বাড়ালে যতটুকু সমালোচনা হবে, ৫ টাকা বাড়ালে তার চেয়ে কম হবে না। তাছাড়া তেলের দাম অল্প অল্প করে কয়েকবারে বাড়ালে সমালোচনার আয়ু অনেক লম্বা হয়, যা এক ধাক্কায় বেশি করে বাড়ালে হয় না।

রোববারের পরিস্থিতিও একই রকম ছিল। সেদিন আবার সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবস। সরকারি-বেসরকারি অফিসগামীদের সঙ্গে সাধারণ যাত্রীদের এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে পড়তে হয। যানবাহন সংকট কিছুটা কমে আসে ওই দিন বিকেলে যখন বাসমালিকদের সঙ্গে সরকারের বৈঠকে একটা সুরাহার খবর আসে। তবে এমন সুরাহাও যাত্রীদের দুর্ভোগ কমাতে পারেনি। শুরু হয়েছে ভাড়া নিয়ে বাস কন্ডাক্টর এবং যাত্রীদের মধ্যে বচসা।

রোববারেই দেখা গেল, বাসমালিক এবং বিআরটিএ- বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি, সড়ক পরিবহন জগতের একমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থার বৈঠকে ঠিক হলো বাসভাড়া বাড়বে ২৬.৫ শতাংশ, কিন্তু ঢাকার সিটি সার্ভিসগুলো ভাড়া নিচ্ছে আগের চেয়ে নিদেন পক্ষে ৫০ শতাংশ বেশি। যেমন গুলিস্তান থেকে ফার্মগেট ভাড়া ছিল ১০ টাকা কিন্তু রোববার সন্ধ্যা থেকে তা হয়ে গেল ১৫ টাকা। গুলিস্তান থেকে আবদুল্লাহপুর ভাড়া ছিল ৩৫ টাকা, কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হলো ৫৫ টাকা। কোনো কিছু না ভেবেই বলা যায়, এ অবস্থা চলবে আরও কিছুদিন, যত দিন না যাত্রীরা এ অযৌক্তিক ভাড়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে না পড়ে।

দেশে স্বল্প ও দূরপাল্লার যত বাস আছে, তার প্রায় সবই এখন ডিজেলে চলে। অতএব ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাসভাড়াও বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ভাড়া বৃদ্ধির একটা নিয়ম আছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমতি নিয়ে ভাড়া বাড়াতে হয়। কাউকে কিছু জানান না দিয়ে যেমন ভাড়া বৃদ্ধি করা যায় না, তেমনি যাত্রী পরিবহনও বন্ধ করা যায় না। অথচ এখানে এবার তেমনটাই হলো।

বাস মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, তারা কোনো ধর্মঘট ডাকেননি, বাসমালিকেরা নিজ নিজ সিদ্ধান্তে বাস বন্ধ করেছেন। সড়ক পরিবহন তো একটা শিল্প। একজন মালিক কি খামখেয়ালিবশত তার প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে পারেন? আমার ইচ্ছা হলে বাস চালাব, না হলে চালাব না, এটা তো জঙ্গলের আইন। ন্যূনতম আইনের শাসন আছে এমন কোনো রাষ্ট্রে তা চলতে পারে না। বিআরটিএর কর্তাদের উচিত ছিল রোববারের ভাড়া বৃদ্ধি ও বৈঠকে সবার আগে মালিকদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কৈফিয়ত আদায় করা। কিন্তু তারা তা করেছেন বলে জানা যায় না।

আসলে বিআরটিএ করবে কী, তাদের মন্ত্রণালয়েরই তো কোনো খবর নেই। বৃহস্পতিবার বাস বন্ধ হওয়ার পর বাস চালু রাখতে মালিকদের প্রতি একটা আবেদন জানিয়েই খালাস তিনি। সরকারি দলে তার অবস্থান দ্বিতীয়। প্রধানমন্ত্রীর পরেই তার স্থান। সে সুবাদে লোকে বলে দেশের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি তিনি। কিন্তু সড়ক পরিবহনের মতো অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ একট মন্ত্রণালয় পরিচালনায় এর কোনো ছাপ কি দেখা যায়?

বাসমালিক ও শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে তার সখ্যতার কথা সবাই জানে। মন্ত্রণালয় চালাতে এর হয়তো দরকারও আছে। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে সড়ক পরিবহনসংক্রান্ত যেকোনো বিষয়ে মন্ত্রী নয়, মালিক-শ্রমিক নেতাদের কথাই শেষ কথা।

এ প্রসঙ্গে বহুল আলেচিত সড়ক পরিবহন আইনের কথা বলা যায়। প্রায় এক যুগের চেষ্টার পর আইনটি ২০১৮ সালে সংসদে পাস হয়। তারও এক বছর পর তা কার্যকর করার ঘোষণা দেওয়া হয়। সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি—সবাই তখন বলেছিলেন আইনটি কার্যকর হলে সড়কে বিদ্যমান নৈরাজ্য অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু শুরুতেই পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের বাধার মুখে আইন কার্যকরের উদ্যোগটি হোঁচট খায়। এরপর বলা হলো, সবার সঙ্গে আলোচনা পর ‘অচিরেই’ তা কার্যকর করা হবে। কিন্তু ২০২১-এও সেই দিনটি আসেনি! পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে সড়ক পরিবহনমন্ত্রীর দহরম-মহরম এ অচলাবস্থা কাটাতে পারেনি।

আমাদের প্রশ্ন হলো, সড়ক পরিবহনে যদি মালিক-শ্রমিক নেতাদের কথাই চূড়ান্ত কথা হয়, তাহলে জনগণের কষ্টার্জিত এত এত টাকা খরচ করে এ খাতের জন্য একজন মন্ত্রীর দরকার কী? বর্তমান পরিস্থিতিতে জনগণ দুদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মন্ত্রী না থাকলে অন্তত জনগণের একটা ভার লাঘব হবে।

যেভাবে ডিজেলের দাম বাড়ানো হলো, তা-ও কিন্তু একটা জনবান্ধব সরকারের পরিচায়ক নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারেও এর প্রভাব পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে এক লাফে লিটারে ১৫ টাকা বৃদ্ধি! সরকার হয়তো ভেবেছে, ১৫ টাকা বাড়ালে যতটুকু সমালোচনা হবে, ৫ টাকা বাড়ালে তার চেয়ে কম হবে না। তাছাড়া তেলের দাম অল্প অল্প করে কয়েকবারে বাড়ালে সমালোচনার আয়ু অনেক লম্বা হয়, যা এক ধাক্কায় বেশি করে বাড়ালে হয় না।

তবে সরকারের মাথায় যে ভাবনাই কাজ করুক, এটা যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর সময় নয়, তা স্বীকার করতেই হবে। প্রথম কথা হলো, সবেমাত্র করোনা মহামারির সর্বনাশা প্রভাব কাটিয়ে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। করোনায়, বিশেষ করে, ছোট ও মাঝারি স্তরের যে মানুষেরা ব্যবসায় বা চাকরি হারিয়েছিল তারা পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়ায় আছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এ প্রক্রিয়াকে কঠিন করে তুলবে। মনে রাখতে হবে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ক্ষতিকর প্রভাব সর্বব্যাপী। তা একদিকে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়, আরেকদিকে বাড়িভাড়া ও যাতায়াত খরচ বৃদ্ধির মাধ্যমে গোটা জীবনযাত্রার ব্যয়কে বাড়িয়ে দেয়।

যারা বলছেন এই সময়ে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে তাদের মনে রাখা দরকার যে মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি পরিমাপের বর্তমান পদ্ধতিটি জনগণের সব অংশের সমহারে আয়বৃদ্ধির নির্দেশক নয়। করোনার মধ্যে একটা অংশের আয় বেড়েছে যে-কারণে দেশে নতুন কোটিপতির সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু বিরাট অংশ তার আয় হারিয়েছে, যার হিসাব ওই মাথাপিছু আয়বৃদ্ধির হিসাবে উঠে আসেনি।

জ্বালানি তেলের দাম গত সাত বছর অনেক কম ছিল। তাই পেট্রোলিয়াম করপোরেশন তথা সরকার প্রচুর লাভ করেছে এ খাত থেকে এ সময়ে। এ লাভ এতটাই যে করপোরেশনকে দেওয়া এর আগের ভর্তুকির পুরোটাই সরকার এ সময়ে তুলে আনতে পেরেছে। এ অবস্থায় সরকার চাইলে আরও ছয় মাস বা এক বছর কিছু ভর্তুকি দিতে পারত জ্বালানি খাতে। এতে অর্থনীতি যেমন স্বাভাবিক গতি পেত, তেমনি জনগণও স্বস্তি পেত। সরকারও তা থেকে বাহবা নিতে পারত।

যেকোনো কারণেই হোক সরকার সে পথে হাঁটেনি। তবে এটা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মনে রাখা উচিত, তাদের এমন সিদ্ধান্তের ফল হিসেবে জনজীবনে যে কষ্ট-দুর্ভোগ বাড়বে, তাদেরও তার প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করতে হবে, সেটা ভোটেই হোক বা অন্য কোনো প্রক্রিয়াতেই হোক।

লেখক: সাংবাদিক