বিজেপির হিন্দুত্ববাদের খপ্পরে পড়া যাবে না

খোকন দাস প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৪, ০৩:৪৮ পিএম

গত ১৫ বছরে এই দেশের হিন্দুদের বাহ্যিকভাবে যতটা না ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ভেতর থেকে, চিন্তার ক্ষেত্রে। আর তা হয়েছে বিজেপির হিন্দুত্ববাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে।

ব্যতিক্রম বাদে এই দেশের হিন্দুদের, ভারতের প্রতি মানসিক-নির্ভরতা আগাগোড়াই ছিল, এর অবশ্য ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক কিছু কারণও আছে। 

তাই বলে এই দেশের সাধারণ হিন্দু জনগোষ্ঠী কখনোই হিন্দুত্ববাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার আগ্রহ দেখায়নি। গত ১৫ বছরে বিজেপির হিন্দুত্ববাদের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হতে দেখা গেছে, অন্যভাবে বললে হিন্দুত্ববাদের প্রতি আকৃষ্ট করানো হয়েছে নানা প্রক্রিয়ায়। বলতে গেলে এটা ছিল বিজেপির একটা প্রকল্প; সেই প্রকল্পের অংশ হয়ে ওঠে বাংলাদেশের সাধারণ হিন্দুরা।

এখানে হিন্দুদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদ বিস্তৃত করার জন্য নানা তৎপরতা চালানো হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম, বিভিন্ন মন্দিরে অনুদান, বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে ধর্মীয় আলোচনার নামে হিন্দুত্ববাদের বয়ান দেওয়া, সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি এই রকম সব ধরনের পন্থাকে কাজে লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া আরও একটা মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে ইসকন। রামকৃষ্ণ মিশন আগে থেকে এখানে ছিল, রামকৃষ্ণ মিশন থাকার পরও ইসকনের কেন প্রয়োজন পড়ল? রামকৃষ্ণ মিশনগুলো ‘যত মত তত পথ’ এই ধরনের ইনক্লুসিভ বক্তব্যই তুলে ধরে, সেটা হয়তো হিন্দুত্ব প্রচারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।

হিন্দুধর্ম পালন আর হিন্দুত্ববাদ কখনোই এক নয়, এই দুটোকে সাধারণ হিন্দুরা হয়তো পৃথক করতে পারেননি। হিন্দুত্ববাদকেই তারা হিন্দুদের ধর্ম পালন মনে করেছেন। বিজেপির হিন্দুত্ববাদের মূল কথা হচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদ, হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

বিজেপির হিন্দুত্ববাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে মুসলমানসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসা ছড়িয়ে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করে ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকা। এতে দলটি বেশ সাফল্যও পেয়েছিল, কিন্তু যত দিন যাচ্ছে হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে বিভাজনের রাজনীতি প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। খোদ ভারতেই যখন এই বিভাজনের রাজনীতির কোনো ভবিষ্যৎ নেই, সেখানে বাংলাদেশে বসে ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা বা দেখানো আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছু নয়।

এই হিন্দুত্ববাদের কারণে সর্বনাশ যেটা হয়েছে তা হচ্ছে, ভারতনির্ভর মানসিকতার হিন্দুদের মানসিক বিকলাঙ্গ করে তোলা। তাদের মধ্যে এই ভাবনা তৈরি হয়েছে যে আওয়ামী লীগ এই দেশে অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে, ওই দেশে বিজেপিও। এখানে হিন্দুদের কিছু হলে মোদি সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে ‘টাইট’ দেবে, আর তখন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে বাধ্য হবে। আরও খারাপ কিছু হলে ইন্ডিয়া চলে যাওয়ার বিকল্প তো আছেই। বিজেপি সরকার তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে, সেখানে তারা সুখে শান্তিতে থাকতে পারবে। এই ধরনের চিন্তা একটা ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কতটা আত্মঘাতী, তা ভাবারও সময় নেই কারও। এই জনগোষ্ঠীকে এই রকম একটা ‘শিকড়হীন’ পরিস্থিতিতে নিয়ে যাওয়ার অন্তরালে যে ক্ষমতাকেন্দ্রিক নিষ্ঠুর রাজনীতি ক্রিয়াশীল, তা নিয়েও কোনো আলাপ নেই। 

এই উপমহাদেশে নির্মম রাজনীতির খেলায় কোথাও হিন্দু, কোথাও মুসলিম, কোথাও শিখ, কোথাও বিহারি সংখ্যালঘু হয়ে অভিশপ্ত জীবন-যাপন করছে, সেটা সব সময় উগ্র জাতীয়তাবাদের ডামাডোলে চাপা পড়ে গেছে। অথচ কান পাতলে শোনা যাবে হিন্দু, মুসলিম, শিখ কিংবা বিহারি সবার কান্নার ভাষা একই, সবারই মনের গভীরের বেদনা অভিন্ন। 

বিজেপির উত্থানের কারণে ভারতে মুসলমানদের বারবার নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। ভারতের মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনা এই দেশের সংখ্যালঘু হিসেবে হিন্দুদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করার কথা। নির্মম সত্য হচ্ছে, সাধারণভাবে সে রকম কোনো উদ্বেগের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়নি। ভারতে মসজিদের ওপর মন্দির নির্মাণ হয়েছে, মুসলমানদের ওপর হামলা হয়েছে, এই দেশের হিন্দুরা রাস্তায় নেমে তার প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ করার সৌজন্যটুকু দেখাতে পারেনি। বরং নরেন্দ্র মোদির রামমন্দির নির্মাণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ভেতরে ভেতরে উৎফুল্ল হয়েছে। এটা যে মানসিক ক্ষয়, এই সত্যকে অস্বীকার করা কি যাবে?


দুর্গাপূজা এ দেশে নতুন কিছু নয়। পূজার আগে আগে স্থানীয়ভাবে পূজা আয়োজনের জন্য কমিটি গঠিত হওয়াই ছিল রেওয়াজ। এ পূজাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে পূজা উদ্যাপন কমিটি গঠন করার মাধ্যমে একটা সাংগঠনিক কাঠামো গঠন এ ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন। পূজা উদ্যাপনের উছিলায় গঠিত এই কাঠামো আদতে হিন্দুদের মধ্যে আওয়ামী লীগেরই একটা সাংগঠনিক কাঠামো। এই সব কমিটির বেশির ভাগই ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের লোকজনই ছিল। এই কাঠামোর মাধ্যমে হিন্দুদের ওপর আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়; অবহেলিত হিন্দু যুবকরা এই কাঠামোর মধ্যে ঢুকে নিজেদের ক্ষমতাবান মনে করছে।

সাংগঠনিকভাবে হিন্দুদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও গত ১৫ বছর হিন্দুদের জমি দখল, হামলা নির্যাতন কোনোটাই থেমে থাকেনি। 

বিশেষ করে দুর্গাপূজার আগে আগে দেশব্যাপী সমারোহে মূর্তি ভাঙা একটা নিয়মিত ব্যাপার ছিল। এই সব ঘটনা যে পরিকল্পিত, তা কারও অজানা ছিল না। এখানে দুটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। 

২০২১ সালে তিন দিনে ৭০টি পূজামণ্ডপে হামলা হয়, ছয়জনের মৃত্যু হয়। হামলার সূত্রপাত হয়েছিল অষ্টমীর দিন কুমিল্লা শহরে। সেখানে একটি পূজামণ্ডপ থেকে কোরআন পাওয়া যায় এবং এর পর থেকে সারা দেশে হামলা শুরু হয়। ওই পূজামণ্ডপে কারা কেন কোরআন রেখেছিল, তা কখনোই কেউ জনতে পারেনি। 

২০২২ সালে সেভাবে মূর্তি ভাঙা হয়নি। ২০২৩ সালে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সরকার অনেক সতর্ক ছিল, যাতে কোথাও হামলা না হয়। তারপরও পূজার আগে এখানে সেখানে মূর্তি ভাঙা হতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত একপ্রকার হুমকির সুরেই বলেছেন, ‘পূজা নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছিল। সেখানে বলেছি, ২০২২ সালে শারদীয় দুর্গাপূজায় কোনো অঘন ঘটেনি। যা ঘটেছিল, তা ২০২১ সালে। অর্থাৎ সরকার চাইলে ঘটবে না, সরকার না চাইলে ঘটবে, এটা এখনকার বাংলাদেশের বাস্তবতা।’

রানা দাশগুপ্তের ওই বক্তব্যের পর কোথাও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেনি। 

এসব হামলার সঙ্গে কারা যুক্ত, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অজানা থাকলেও এই হামলাগুলো যে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যমূলক, এই হামলাগুলো যে মৌলবাদী শক্তি দায়ী, তা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হতো। এর মাধ্যমে সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল গ্রহণ করত; একদিকে ভারতকে এই বার্তা দেওয়া হতো, আওয়ামী লীগ সরকার না থাকলে এই দেশের হিন্দুরা কোনোভাবে নিরাপদে থাকবে না; মৌলবাদীদের হাত থেকে হিন্দুদের নিরাপত্তার স্বার্থেই বিজেপি সরকারের উচিত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখা। অন্যদিকে হিন্দুদের বোঝানোর চেষ্টা করত মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচতে হলে আওয়ামী লীগকে আশ্রয় করেই টিকে থাকতে হবে।

২০২২ সালে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভা শেষে (২৯ সেপ্টেম্বর) ডিএমপি কমিশনার শফিকুর ইসলাম বলেছেন, ‘দুর্গাপূজায় জঙ্গি হামলার আশঙ্কা আছে। পাশাপাশি ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচারের মাধ্যমে স্থিতিশীলতা তৈরির আশঙ্কাও আছে।...আমরা ইতোমধ্যে জানতে পেরেছি যে প্রায় ৫০ জন যুবক বাড়ি ছেড়েছেন। তাদের কোথায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তা জানতে আমরা কাজ করছি।’

একটা জনগোষ্ঠী কীভাবে বিগত বছরগুলোতে ভারতের বিজেপি সরকারের এবং এ দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতায় থাকার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, তা বেশির ভাগ হিন্দু জনগোষ্ঠী বুঝতেই পারেননি, আর যারা বুঝতে পেরেছেন, তাদেরও করার কিছু ছিল না।

৩. 
সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু জনগোষ্ঠীর প্রধান উৎসব মূলত দুটি, এক ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি বা জন্মাষ্টমী আর অন্যটি হচ্ছে দুর্গাপূজা। এই দুটি উৎসবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি, জাঁকজমকপূর্ণ অবস্থা ও পূজামণ্ডপের সংখ্যা দিয়ে এই দেশের হিন্দুরা কেমন আছে, তা নিরূপণ করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে।

গত ৫ বছরের সারা দেশে দুর্গামণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র

সালপূজামণ্ডপের সংখ্যা
২০১৯ ৩১,১৮৩
২০২০৩০,২২৫*
২০২১  ৩২,১১৮
২০২২৩২,১৬৮
২০২৩৩২,৪০৮

*করোনার কারণে ২০২০ সালে মণ্ডপ ৮৫৮টি কমেছে

দুর্গাপূজার মণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি ও জৌলুশ দেখানোর মাধ্যমে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে বোঝাতে চেয়েছে এই দেশের হিন্দুদের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে, আবার হিন্দু নেতারা এর মাধ্যমে নিজেদের গর্বিত মনে করে তুলেছেন। 

এবার আমরা অন্য একটা তথ্যের দিকে দৃষ্টি দিই। স্বাধীনতার পর থেকে এই দেশে হিন্দুদের সংখ্যা ক্রমাগত কমেছে; ১৯৭৪ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ১৩.৫ শতাংশ, ২০২২ সালে সর্বশেষ শুমারিতে দখো যায় এই সংখা কমে হয়েছে ৭.৯ শতাংশ। এই সংখ্যা হ্রাসের পেছনে তিনটা কারণকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে; এর একটি মাইগ্রেশন, অন্য দুটি হচ্ছে শিশু মৃত্যুহার ও টোটাল ফার্টালিটি হার তুলনামূলকভাবে কম। এই তিনটাই কারণই এই দেশের সাধারণ হিন্দুদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনমানের অবনতির চিত্র।

১৯৭৪ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত হিন্দুদের জনসংখ্যা হ্রাসের হার        

সালজনসংখ্যার হার
১৯৭৪ ১৩.৫ %
১৯৮১১২.১ %
১৯৯১   ১০.৫ %
২০০১৯.২ %
২০১১৮.৫ %
২০২২৭.৯ %

স্বাধীনতার পর, এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরের শাসনামলেও এই দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমেছে। অন্যদিকে দুর্গাপূজার মণ্ডপের সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়েছে। বছর বছর পূজামণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে হিন্দু জনগোষ্ঠী যতটা ব্যস্ত ছিল, জনসংখ্যা ক্রমাগত কমে যাওয়ার কারণগুলো দূর করার বিষয়ে নেতাদের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। পূজার মণ্ডপের সংখ্যা দিয়ে হিন্দুদের ক্ষমতায়নের কৃত্রিম ইমেজ তৈরি যে একটা রাজনীতি ছিল, তা কেউ বোঝারই চেষ্টা করেনি।

একদিকে ভারতের বিজেপি আওয়ামী লীগকে ক্ষতায় টিকিয়ে রেখে নানা সুবিধা আদায় করতে এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হিন্দুরা ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কথিত বন্ধুত্বের আড়ালে দেশের ভেতরে ও বাইরের এই দ্বিমুখী জাঁতাকলে হিন্দুরা নিষ্পেষিত হয়ে এসেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এই যূপকাষ্ঠ থেকে হিন্দুরা নিজেদের মুক্ত করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। সুযোগ এসেছে একটা ফ্যাসিস্ট কাঠামো থেকে নিজেদের মুক্ত করার। সময় এসেছে কীভাবে এই দেশের হিন্দুরা হিন্দুত্ববাদের খপ্পরে পড়ে প্রায় শিকড়হীন হয়ে পড়েছে, সে ব্যপারে আত্ম-উপলব্ধি করার এবং সবকিছু নতুন করে পুনর্গঠনের। গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় দেশের হিন্দুদের প্রথমেই হিন্দুত্ববাদকে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে। হিন্দুত্ববাদ আর হিন্দুদের ধর্ম পালন এক বিষয় নয়, তারা অবশ্যই ধর্ম পালন করবে, বিজেপির এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে যাবে না। তবে ধর্ম পালনের অধিকার যেমন থাকবে তেমনি কেউ পালন করতে না চাইলে তার সেই অধিকারও থাকতে হবে। এই দেশ হিন্দু মুসলিমসহ সব ধর্ম এবং ছোট-বড় সব জাতির মানুষের। দেশের স্বাধীনতার জন্য অকারতে হিন্দুরা জীবন দিয়েছে, এই দেশের পুনর্গঠনেও হিন্দুদের অবদান আছে। বললে অত্যুক্তি হবে না, এই দেশের শিক্ষার প্রসারই ঘটে হিন্দু শিক্ষকদের হাত দিয়ে। জোরগলায় বলতে হবে, এই দেশে আমরা জন্মেছি, এই দেশ আমার দেশ, ভারত আমার দেশ নয়। যেকোনো দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়টা সেই দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল। গণতন্ত্রের মূল কথা সহনশীলতা, সব মত-পথের মানুষকে নিয়ে একসঙ্গে পথচলা। এই পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে সবার দায়িত্ব আছে। হিন্দুদের মধ্যে যারা ‘এই দেশের হিন্দুরা জন্মগতভাবে আওয়ামী লীগ’ এই ধরনের বক্তব্য প্রচার করেন তারা প্রকারন্তরে নিজেদের পায়ে নিজে কুড়াল মারছেন। কোনো নাগরিকের যে কোনো বৈধ রাজনৈতিক দল করার অধিকার আছে, হিন্দুদের মধ্যে কেউ আওয়ামী লীগ করবে, কেউ বিএনপি করবে, কেউ অন্য কোনো পার্টি করবে; কিন্তু হিন্দু বলে একটা নির্দিষ্ট দল করতে হবে, এই যুক্তি অগণতান্ত্রিক ও আত্মঘাতী। এই আত্মঘাতী কাজটাই এই দেশের হিন্দুধর্মাবলম্বীরা করে এসেছে। এখন জোরগলায় একটা সত্য উচ্চারণ করতে হবে, তা হচ্ছে হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রতিবেশী মুসলমানরাই, ভারত বা ভারতের বিজেপি সরকার নয়। সব মুসলমান হিন্দুবিরোধী হলে এই দেশের হিন্দুরা কি টিকে থাকতে পারত? তাই এখন সময় এসেছে স্পষ্ট করে এই কথাটা বলার যে আমরা ভারতের কাছে নিরাপত্তা চাই না।

আগেই বলেছি, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা সবার আছে। তবে এই কথাও মেনে নিতে হবে, হিন্দুরা বিশ্বদরবারে স্থান করে নিয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে নয়। যারা কতটা মণ্ডপে পূজা হচ্ছে, এই পরিসংখ্যানের মধ্যে হিন্দুদের কৃতিত্ব খুঁজতে চান, বুঝতে হবে তারা হিন্দুদের প্রকৃত বন্ধু নন। পূজার মণ্ডপের সংখ্যা দিয়ে নয়, হিন্দুরা পরিচিত হবে কতজন বিচারপতি হয়েছেন, কতজন সচিব হয়েছেন, কতজন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার, কতজন বিজ্ঞানী, হয়েছেন এই পরিসংখান দিয়ে। 

আমার মতে, এখন নতুন স্লোগান হওয়া উচিত: ১. বিজেপির হিন্দুত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করি, নতুন বাংলাদেশ গঠন করি। ২. ভারত বা বিজেপির কাছে আমরা নিরাপত্তা চাই না, আমাদের নিরাপত্তা দেবে প্রতিবেশী মুসলিমরা। ৩. ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর কোনো অজুহাতে নির্যাতন করা যাবে না। ৪. পূজামণ্ডপের সংখ্যা দিয়ে নয়, হিন্দুরা গৌরব বোধ করবে শিক্ষার হার দিয়ে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষিত হওয়ার হার দিয়ে। ৫. দখল হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার করতে হবে। ৬. এ দেশের হিন্দুরা যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে, কোনো বিশেষ দলের ভোট ব্যাংক হবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক