কেমন বাংলাদেশ চাই

মো. ওমর ফারুক প্রকাশিত: আগস্ট ১২, ২০২৪, ০৫:২৬ পিএম

প্রায় ১৭ বছর আগের ঘটনা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। ২০০৭ সালের ২১ আগস্ট ভর দুপুরে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাসভবন সংলগ্ন মোড়ে। নীলক্ষেতের দিক থেকে পুলিশ অনবরত টিয়ারসেল নিক্ষেপ করছে আর আমরা ছাত্ররা তা হাতে নিয়ে আবার পুলিশের দিকে নিক্ষেপ করছি। ছাত্রদের এই বিক্ষোভের হাওয়ায় পাল তুলে ২০০৯-এর জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে এবং প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসকের দুঃশাসনই ছিল ছাত্র-জনতার প্রাপ্তি।

১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পথে এবং সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারত। দুর্ভাগ্যবশত এরশাদের পতন ছাড়া গণঅভ্যুত্থানের এই ইতিহাস আর কিছুই দেয়নি। ঘটনার পুনরাবৃত্তি এই হয়েছে যে, কিছু স্বার্থপর মহল তাদের আখের গুছিয়েছে। আর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ জুলুমের যাতা কলে নিষ্পেষিত হয়েছে।

স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকেও আমরা অর্থনৈতিক আর সামাজিক বৈষম্য দূর করতে পারিনি, বরং আজকের দিনে এ বৈষম্য আরও তীব্র হয়েছে। আজকের দিনে বাংলাদেশের যেদিকে তাকানো যায়, শুধু বৈষম্য ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বৈষম্য চোখে পড়ার মতো। দেশের বেশির ভাগ খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান ঢাকায়।

২০২৪ সালের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের অধিক সময়ের শাসনের সমাপ্তি ঘটে। তাজা রক্ত দিতে হয় পাঁচশত-র অধিক ছাত্র-জনতাকে। আর হাজার হাজার ছাত্র জনতাকে বরণ করে নিতে হয় পঙ্গুত্ব।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন নূর হোসেন। সেই ছবি এখনো গণতন্ত্রকামী ছাত্র-জনতার কাছে একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। নূর হোসেনের বুকে ও পিঠে লেখা ছিল স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক। ২০২৪ সালের আজকের বাংলাদেশে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, রিয়া গোপের মতো ছোট্ট শিশুসহ যাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকে যেন এক এক জন নূর হোসেন। উপমহাদেশের কোন স্বাধীন রাষ্ট্রে এত কম সময়ে এত অধিকসংখ্যক মানুষকে হত্যার নজির ইতিহাস আর কখনো দেখিনি।

কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পরপরই জাতি যে দৃশ্য দেখল তা আমাদের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে। সংসদ ভবনের চেয়ার থেকে শুরু করে বাথরুমের  কমোডটি পর্যন্ত লুটপাট থেকে রেহাই পায়নি। তাহলে এত রক্ত, এত মায়ের বুক খালি কেন? তাই দেশের সাধারণ মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।

আমাদের সকলের উচিত বিবেক ও নীতিনৈতিকতার আলোকে উদ্ভাসিত হওয়া, যেন আমরা সমাজের প্রতি আমাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক যা আমাদের নজরে এসেছে তা এই যে, শুধু সরকার পতনই নয় বরং সরকার পরবর্তী বিশৃঙ্খল পরিবেশে স্বেচ্ছায় দেশব্যাপী মাঠে নামা, আর যেখানে আমরা দেখতে পাই লুটরাজকারীদের কাছ থেকে মালামাল ও নগদ টাকা হেফাজতে নিয়ে তা সেনাবাহিনীর কাছে ফেরত দেওয়া, আবার ঢাকার রাস্তার যানজট নিরসনে নিজেরাই কোমর বেঁধে ট্রাফিক পুলিশের কাজ করা। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা, আবার অন্যদিকে দুর্বৃত্তকারী ডাকাতদের হাত থেকে জনগণের জানমাল রাত জেগে পাহারা দেওয়া। আর এই সব কিছুর মূল এটাই যে ছাত্ররা সংস্কারমূলক সরকার ব্যবস্থার এক রূপরেখা নিয়ে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে সংকল্পবদ্ধ।

ছাত্রদের প্রস্তাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করে সরকার গঠন করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকেও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। শেখ হাসিনার পদত্যাগে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেনাবাহিনী, তেমনি দেশের এই ক্রান্তিকালেও সেনাবাহিনীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

একইভাবে, আমাদের দায়িত্ব দেশের সমস্ত নাগরিককে তাঁদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা। সবার মতামতের মূল্য দিতে হবে এবং জনগণের সঠিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দেশের প্রশাসন স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হয়।

১৭ বছর আগের একটি গানের লাইন বারবার আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনে ঘুরে ফিরে আসত। তা হলো, ‘তিরিশ বছর পরও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।’

ছাত্রদের এই স্বপ্ন কি আসলেই পূরণ হবে? কারণ স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করাই কঠিন। এই কথাটি ভুলে গেলে চলবে না।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও প্রধান, এমবিএ প্রোগ্রাম, ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অফ আইটি