বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন : ভারতে কি প্রভাব ফেলবে?

সলিমুল্লাহ খান প্রকাশিত: আগস্ট ৭, ২০২৪, ০৪:০০ পিএম
সলিমুল্লাহ খান

(বাংলাদেশে জুলাই মাসে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রক্তক্ষয়ী সংঘাতে পরিণত হয় এবং শেষের দুই সপ্তাহের ভেতর তিন শতাধিক মৃত্যুর পর ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লিখে সলিমুল্লাহ খান আমাকে পাঠান। ৬ আগস্ট সকালে মোবাইল ফোনে লেখা এই নাতিদীর্ঘ লেখাটি তিনি একটি ইংরেজি দৈনিকে পাঠিয়েছেন । এখানে আমরা নাতিদীর্ঘ  নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে  অনুবাদ করেছি ।- বিধান রিবেরু )

--------------------------------------------------------------------------------------------------

ভ্লাদিমির লেনিন, আদতে, ঠিকই বলেছিলেন! কখনো কখনো দশকের পর দশক চলে যায় কিছুই ঘটে না; আর কখনো কখনো এমন কোনো সপ্তাহ আসে, যখন কয়েক দশকের মতো ঘটনা ঘটে যায়! জয় হোক সেসব শহীদ এবং পথপ্রদর্শকদের, যাঁরা ১৯৭১ সালের পর আবারও বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে  লিপ্ত হয়েছেন।

আগস্ট মাসের শুরুর সপ্তাহে যেন বাংলাদেশে কয়েক দশকের ঘটনাই ঘটে গেল। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ) শাসনের পতন যদি ট্র্যাজেডি হয়, তাহলে ২০২৪ সালের আগস্টে আওয়ামী শাসনের উচ্ছৃঙ্খল প্রস্থান পূর্বের পুনরাবৃত্তি। একে হয়তো  মনে হবে প্রহসন। গত দুই দশকে কম রক্তপাত হয়নি। তাই এই শাসনের পতন অনেকের জন্য স্বস্তির কারণ বটে, তবে দিগন্তে এখনো রয়েছে ঘোর মেঘের ঘনঘটা।

সমুখে এখন অনেক কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে। সেগুলোর ভেতর একটি হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ ভারতের উদ্বেগ। বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির—এখন পর্যন্ত—উদ্বেগও কম নয় । তবে অল্প পরিসরে দ্বিতীয় উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা সম্ভব নয় বলে আমি সেটি থেকে বিরত থাকলাম।  আজ আমি বরং শুধুমাত্র ভারতের বিষয়েই কথা বলি।

জুলাই-আগস্টে আন্দোলনকারীদের যে সাহসিকতা আমরা দেখেছি, যে গৌরবময় অর্জন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, সেটি হয়তো অনেকের কাছেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি  মনে হতে পারে। মনে রাখতে হবে, এই অর্জন কিন্তু পুরোপুরি শূন্যে বিলীন হবে না।

১৯৭৫ সালের সামরিক অভ্যুত্থান গোপনে সংগঠিত হয়েছিল। এতে বেসামরিক লোকও কিছু জড়িত ছিল। ঘটনাটি যে একটি পশ্চিমা শক্তির দ্বারা সমর্থিত ছিল তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বলা যায়, এই আন্দোলনের যে পরিবর্তনশীল গতি তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা, আর তা সমর্থন পেয়েছে নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক দলের একাংশের। সর্বোপরি আন্দোলনে  তথাকথিত "আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের" সমর্থনও লক্ষণীয়। এখন এর প্রভাব কোথায় কিভাবে পড়বে, তা অতীতের চেয়েও অস্পষ্ট। অন্তত অর্ধশতাব্দী আগে যা ঘটেছিল, তার তুলনায় তো বটেই ।

১৯৭৫ সালে পিতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ শাসন উন্মত্ত ছিল “এক জাতি এক নেতা” মন্ত্র নিয়ে। ২০২৪ সালে, কন্যার শাসনও  উগ্র হয়ে ওঠে সমধিক নির্মমতা নিয়ে। তাই ইতিহাস নিজেই নিজের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে।

অদূর ভবিষ্যতে কি ঘটতে যাচ্ছে, তা নিয়ে  সম্ভবত এখনই কিছু বলা সম্ভব নয় । বললে খুব তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে। তবে একটি প্রশ্ন মনে উঁকি দিয়ে যায়: ৫ আগস্ট বিপ্লবের ধরনটা কেমন? এটি কি ফরাসি বিপ্লবের মতো একটি জনপ্রিয় বিপ্লব, যা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ঝাণ্ডা ধরে রেখেছে? নাকি এটি এক ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান, সিভিল সোসাইটির ১৮ই ব্রুমেয়ার, যা “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের” মদতপুষ্ট, সশস্ত্র বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত? প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বাগত জানানো ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির ঘটনাবলী  থেকে এই ঘটনা কতটুকুই বা আলাদা? ইতিহাস থেকে আমরা খুব একটা শিক্ষা নিতে চাই না, ইতিহাসের দোকান থেকে এই একটা শিক্ষাই বোধ হয় আমরা খরিদ করি।

খালি থালা থেকে কেউ কোনো কিছু নিতে চায় না। অন্তত কোনো প্রতিবেশী তো নয়ই। সকলেই জানে, এই দেশ বা সেই দেশ উদারতা কিংবা কার্পণ্য যাই দেখাক না কেন, সে তাদের নিজ নিজ স্বার্থের সাথে সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশে বংশানুক্রমিক স্বৈরাচারকে সমর্থন করার ক্ষেত্রে কি বাংলাদেশের অনিবার্য প্রতিবেশী ভারতও নিজের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়নি? যা তারা সমর্থন করেছেন, তার চেয়ে ভালো বিকল্প কি তাদের হাতে আর ছিল না? অন্তত এবার কি তারা সততার সাথে, অকপটতার সঙ্গে কোনো শিক্ষা নেবেন? এসব প্রশ্নের জবাব ভারতের রাজনৈতিক বোদ্ধারাই ভালো দিতে পারবেন। ভারতমাতা যে রত্নপ্রসবিনী তাতে স্নেহের অবকাশ নেই।

আমাদের পক্ষে, একটি অবরুদ্ধ ভূমির নাগরিক এবং বাসিন্দা হিসেবে, এটি একটি একক-খরিদ্দার বিকল্পের মতো। বিশেষ শাসন সমর্থন করার ক্ষেত্রে ভারতের যে নির্লজ্জ স্বার্থপরতা আমরা দেখেছি, তা স্পষ্টতই উদার গণতন্ত্রের সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করে এবং তাঁদের হ্রস্বদৃষ্টি হাজির করে। এখন তো এটি আগের চেয়েও প্রকট হয়ে প্রমাণিত হচ্ছে। এটি আমাদের কাছে (অন্তত যারা প্রতিবেশীর ছায়াতলে আছি) আরও বেশি মনে হয়, বাঁদরের কররেখার মতো, অবর্ণনীয়!

কোন ধরনের বিকল্প থেকে ভারতের বাছটা বেছে নিতে হয়েছিল সেটা স্পষ্ট নয়, এমনকি সেটা আমাদের জানারও বাইরে। তবে পুরো বিষয়টি মোটেও অস্বচ্ছ নয়।

১৯৭৫ সালে, ভারত তার নিম্নপ্রবাহের প্রতিবেশীকে কার্যত উপেক্ষা করে গঙ্গা-পদ্মাকে সম্পূর্ণভাবে অভ্যন্তরীণ জলপথ হিসেবে দাবি করেছিল। এটি যে একটি আন্তর্জাতিক নদী, এই সত্য হয়তো তখন তারা অজ্ঞাতসারে ভুলে গিয়েছিলেন। অন্যান্য জলপথের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান তখন থেকে খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি। এখন তিস্তা ও অন্যান্য অনেক সাধারণ আন্তর্জাতিক জলপথের পানি আর স্বাভাবিক ধারায় প্রবাহিত হয় না, বা অনেক নদী হয় তো মরে গেছেই।

তদুপরি সীমান্তে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড শুধুমাত্র ভারতের রাজনৈতিক পেশীর রহস্যময় প্রতীক নয়, বরং তার স্বল্পদৃষ্টির প্রতীকও বটে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার, ভারতের রাজনীতি বিষয়ে এক বিশেষজ্ঞ 
মন্দ বলেননি: "ভারতের বাংলাদেশ সমস্যা"।

তাঁরা তাদের অসুদর্শন প্রতিবেশীদের ‘ঘূণপোকা’ বলে ডাকেন।
ভারতের চীন-বালাই, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে  ১৯৬২ সালে যুদ্ধের পর থেকে, সম্ভবত ভারতের বাংলাদেশ নীতিকে দিকভ্রান্ত করেছে। কিন্তু একটি জনগোষ্ঠী, যারা আড়াই দশক ধরে পাকিস্তানের  অধীনে এক ধরনের ঔপনিবেশিক দমনমূলক শাসন মেনে নেয়নি, তারা ভারতের চাপিয়ে দেয়া প্রবাদপ্রতিম  "অধীনতামূলক মিত্রতা" নীতিকে স্বাগত জানাবে তা আশা করা যায় না (শাসকেরা এই নীতি মেনে নিলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্ত দেশের জনগোষ্ঠী তা কখনো মেনে নেয় না)।

এখন এই জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থানের পর শাসনামলের যে পরিবর্তন হলো, তা দক্ষিণ এশিয়ার দুই সার্বভৌম প্রতিবেশী দেশ, যারা বহু শতাব্দী ধরে অভিন্ন ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে, তাদের ভেতর ভবিষ্যৎ সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে।

প্রতিবেশীকে ভিক্ষুক বানানো বা একজনের সুবিধার্থে অন্যজনকে দরিদ্র করার নীতি কেবল এমন শাসন দ্বারা অনুমোদিত হতে পারে, যেরকম শাসন সদ্য নবমুক্তিপ্রাপ্ত  বাংলাদেশে বিদায় নিয়েছে।

ভারত দেশটি অনেক প্রবাদপ্রতিম জ্ঞানীর জন্মভূমি। আমি নিশ্চিত যে তারা “অখণ্ড ভারত” বা এই ধরনের কোনো বৃষ-যুদ্ধের কাল্পনিক ভূতের আছরে আক্রান্ত বা বিভ্রান্ত হবেন না। এগুলো ধোপে টিকবে না।

বাংলাদেশের আগস্ট ২০২৪ সালের শাসন পরিবর্তন সম্ভবত এই জনগোষ্ঠী বা জাতির জাতীয় পরিচয় নিয়ে চিন্তা করার নতুন সুযোগ তৈরি করে দেবে। এই বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত  (কিংবা যাঁদের বলতে পারেন "আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদ") তারা যদি উপেক্ষা করেন তাহলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না।

ইতিহাস যেন দ্বিতীয়বারের মতো ট্র্যাজেডি ফিরিয়ে আনতে না পারে। রাজধানী ঢাকার শাসন পরিবর্তন, সম্ভবত, তথাকথিত “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের” আশীর্বাদ লাভ করেছে । তবে, এটি কার্যকরভাবে কাজ করবে না, যদি ভারত আজ না ভাবে যে কেমন পরিস্থিতি আগামীকাল তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করবে।

ভারতের সবচেয়ে বড় স্বার্থ সম্ভবত বাংলাদেশের  নতুন গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণের ভেতর নিহিত। তবে তাদের মনে রাখতে হবে, কোনো কারণেই যেন পূর্বের প্রতিবেশী দেশে নতুন প্রজন্মের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাধাগ্রস্ত না হয়।

 

৬ আগস্ট

 

দোহাই
নাভিন মুরশিদ, ইন্ডিয়া‍‍’স বাংলাদেশ প্রবলেম (ভারতের বাংলাদেশ ব্যথা), (ক্যামব্রিজ, ইউকে: ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০২৪)।

 

অনুবাদ: বিধান রিবেরু