যে কারণে এখনও নারী কোটা প্রাসঙ্গিক

তানিয়া কামরুন নাহার প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২৪, ১২:০৩ পিএম

সম্প্রতি আপিল বিভাগের রায়ে দেশের সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার নতুন বিন্যাস করা হয়েছে। চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ভিত্তিক ৯৩ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য ৫ ভাগ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ১ ভাগ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ ভাগ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এখানে কোনো নারী কোটা নেই। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নারী শিক্ষার্থীরাও কেন এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের নজরে আনলেন না, তা বোধগম্য নয়। প্রিভিলেজড নারী হিসেবে অবশ্যই কোটার দাবি করা উচিত নয়। কর্মক্ষেত্রে নারী কোটা সুবিধা তারা কখনো নেবেনও না, নেওয়া উচিতও নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের আর সব নারীর কথা আমাদের সবার অবশ্যই ভাবা উচিত। রাষ্ট্রে এখনো নারী কোটার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। কেন যায়নি, সে কথাই বলছি। 

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, করোনাকালিন মেয়েদের বাল্যবিয়ের এক প্রকার হিড়িক পড়েছিলো। সেই মেয়েদের অনেকেই চিরকালের জন্য পড়ালেখা থেকে ঝরে পড়েছে। যারা টিকে রয়েছে, স্বামী, সংসার, সন্তান সব এক হাতে সামলিয়ে কোনো ক্রমে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে। অপ্রাপ্তবয়স্ক গর্ভবতী পরীক্ষার্থীরা কীভাবে পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে অংশ গ্রহণ করে, তাদের কষ্টকর মুহূর্তগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবেই নারী কোটার প্রয়োজন ভীষণভাবে অনুভব করি। শুধু করোনাকাল নয়, এখনো প্রচুর মেয়েকে পরিবারে থেকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

আমাদের চারপাশে তাকালেই প্রচুর উচ্চশিক্ষিত ও নিজ মেধা, কর্ম ও যোগ্যতায় প্রতিষ্ঠিত নারীদের দেখতে পাবেন,  সংসার ও সন্তান সামলাতে প্রতিনিয়ত তাদের কী পরিমাণ সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে! সংগ্রাম করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলে অনেকেই নিজ ক্যারিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে হয়ে গেছেন পুরো দস্তুর গৃহিণী। এক সময় যাদের পরিচয় ছিলো ব্যাংকার, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, তাদের পরিচয় আজ হয়ে গেছে শুধুই অমুকের মা। মাতৃত্ব নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধার ও আনন্দের এক আবেগ ও অনুভূতি। কিন্তু এটিই কি একজন নারীর একমাত্র পরিচয় হতে পারে? অমুকের কন্যা বা স্ত্রী কিংবা মা, অন্যের পরিচয়ে নারীরা আর কতদিন পরিচিত হয়ে মেকি গর্বে গর্বিত হতে থাকবে? পারিবারিক, সাংসারিক, সন্তান প্রসবজনিত কারণে স্বল্প বা দীর্ঘ বিরতির পর এই নারীরা আবার যদি নিজেদের ক্যারিয়ারে ফিরে আসতে চায়, তাদের জন্য কি আসলেই কোনো সুযোগ রাখা হয়েছে?

কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হতে পারে মেধা ও যোগ্যতা। কিন্তু মেধা ও যোগ্যতা বিকাশে নারীর চলার পথ কি আসলেই মসৃণ? এখনো পরিবারগুলোতে শুধুমাত্র কন্যা সন্তান বলে তার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে অভিভাবকদের মধ্যে অনাগ্রহ রয়েছে। এছাড়াও প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক নারী যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়ে থাকেন। যত মেধাবীই হোক না কেন, যে নারীরা এসব ট্রমার সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের সামনে এগিয়ে চলার পথ অবশ্যই বাধাগ্রস্ত হয়। আপনাদের কি মনে হয় না, চ্যালেঞ্জিং এই নারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নারী কোটার প্রয়োজন আছে?

জেন্ডার সমতা অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে তিনি নারী হোন কি পুরুষ, যে কোনো প্রার্থীর, মেধা ও যোগ্যতাকেই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ধরতে হবে। কিন্তু আমাদের পরিবারগুলো, সমাজ ও রাষ্ট্র কি আজও নারীবান্ধব হতে পেরেছে? ঘরে বাইরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কিংবা ভার্সিটি) কোথাও কি নারীকে যৌন হয়রানি থেকে সম্পূর্ণভাবে নিরাপত্তা দিতে পেরেছে? পারে নি। যতদিন পর্যন্ত আমাদের পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ১০০% নারীবান্ধব না হবে, ততদিন পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে অন্তত ১% নারী কোটা থাকতেই হবে। কোনো সম অধিকারের নামে, নারীদের এই কোটার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। প্রিভিলেজড নারী শিক্ষার্থীরাও ভেবে দেখতে পারেন, রাষ্ট্রে নারী কোটার প্রয়োজনীয়তা আসলেই কি ফুরিয়ে গেছে কিনা। 

যে পুরুষ শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করলেন, তাদের কাছেও প্রশ্ন রইলো—আপনাদের পরিবারের মেয়েরা কি শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে আপনাদের মতোই সমান অধিকার পায়, পেয়ে থাকে? পরিবারে থেকে কোনো ধরনের বৈষম্যের শিকারই কি তারা হয় না? যেকোনো স্টাডি ট্যুরে তারা কি আপনাদের মতোই বাধাহীনভাবে অংশ নিতে পারে? আপনাদের পরিবারের শিক্ষিত নারীদের বিয়ের পর ও সন্তান প্রসবের পর ক্যারিয়ারে কি কোনো সংগ্রামেরই মুখোমুখি হতে হয়নি? আপনাদের পরিবারের নারীরা কি ঘরে বাইরে সম্পূর্ণভাবে যৌন হয়রানির ঝুঁকি মুক্ত? প্রশ্নগুলোর অন্তত একটি জবাবও যদি ইতিবাচক না হয়ে থাকে, তাহলে নারী কোটার বিপক্ষে কোন মুখে কথা বলেন? আগে সম অধিকার প্রতিষ্ঠা করুন, এরপর নারী কোটা বিলুপ্ত করুন।

লেখক : শিক্ষক ও লেখক