গৌরব ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ৭৫ বছর

নুরুজ্জামান মানিক প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৪, ০৮:২৯ এএম

আজ ২৩ জুন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এইদিনে পুরানো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানি সামরিক শাসন, জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে সব আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে আওয়ামী লীগ। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুবের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেয়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এরপর ৩ নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার মাধ্যমে এই সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়। পরে শুরু হয় সামরিক শাসন। এ সময় স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনেও রাজপথে নামে আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। এ সময় তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে সংগঠনকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। আবারও শুরু হয় রাজপথের আন্দোলন সংগ্রাম। নব্বইয়ের স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে দলটি। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জয়ী হয়ে ২৩ জুন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে আসে। শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। ২০০১ এবং ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর আর এক দফা বিপর্যয় কাটিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশ আসনে বিজয়ী হয়ে আবারও রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় দলটি।

আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরেই দেশ থেকে দূর হয়েছে ক্ষুধা ও দারিদ্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ও রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করে, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনেও জয়লাভ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে, টানা চতুর্থবার ও মোট পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ এখন উন্নত বিশ্বের তালিকায় নাম লেখানোর স্বপ্নময় পথ অতিক্রম করছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্নের গণ্ডি ছড়িয়ে বিশ্বের বিস্ময় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছে দেশের মানুষ। বীরের জাতি হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মান ফিরে পেয়েছে বাঙালি জাতি। এক যুগের চলমান সুশাসনে দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। স্বাধীনতার পর গত তিন যুগের অধিক সময়ে যা সম্ভব হয়নি, আওয়ামী লীগ সরকারের সর্বশেষ এক যুগে তাই সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের ইতিহাস, দেশ ও মানুষের জন্য নিবেদিত থেকে আত্মদানের ইতিহাস। সুখে-দুঃখে- দুর্যোগে দুর্বিপাকে- সর্বদা গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে- সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে এগিয়ে যাওয়াই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দৃপ্ত প্রত্যয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস লিখলে অবশ্যই আসবে আওয়ামী লীগ ও তার কান্ডারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম । তাই আওয়ামী লীগের ইতিহাস জানা জরুরি। প্রসঙ্গতঃ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হওয়ার পর উর্দুভাষী খাজা নাজিমউদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হলে তিনি সোহরাওয়ার্দী সমর্থক সকলকেই বাদ দিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পূর্ব পাকিস্তানকে ভালোভাবে কব্জা করার জন্য প্রাদেশিক চিফ সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয় অবাঙালি আজিজ আহমদকে। মেজর জেনারেল আইয়ুব খান আসেন জিওসি হয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত উচ্চপদেই বসানো হয় পশ্চিম পাকিস্তানি অথবা ভারত থেকে আগত অবাঙালি আমলাদের। কেন্দ্রে তো বাঙালিদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না। রাজধানীসহ রাষ্ট্রের যাবতীয় সদর দফতর স্থাপন করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ফলে ভারত থেকে যেসব পুঁজিপতি পাকিস্তানে চলে এসেছিল তারা স্বভাবতই তাদের পুঁজির স্বার্থে পশ্চিম পাকিস্তানেই স্থিতিলাভ করে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমান মর্যাদা ও সুযোগ দেয়ার কোনো চিন্তা পাকিস্তানি শাসক-চক্রের নেই। এমতাবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানের সকল সচেতন মানুষ এই অঞ্চলের জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিকল্প সংগঠনের অপরিহার্যতা অনুভব করে। 

২৩ জুন ১৯৪৯ বেলা তিনটায় কাজী হুমায়ুন বশীরের কে এম দাস লেনস্থ বাসভবন রোজ গার্ডেনের দোতলার হলঘরে মুসলিম লীগের এক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ২৫০ থেকে ৩০০ কর্মী উপস্থিত হন। আতাউর রহমান খান মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। অনেক আলোচনার পর ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে নতুন একটা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনে বিবেচনার জন্য শামসুল হক মূল-দাবী নামে পুস্তিকা আকারে একটি কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে আটক থাকার কারণে এই সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি। অধিবেশনের শেষ দিকে ৪০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (সভাপতি), আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ খান, আলী আমজাদ খান ও আবদুস সালাম খান (সহ সভাপতি),শামসুল হক (সাধারণ সম্পাদক), শেখ মুজিবুর রহমান (যুগ্ম সম্পাদক), খন্দকার মোশতাক আহমদ ও এ কে এম রফিকুল হোসেন (সহ-সম্পাদক) এবং ইয়ার মোহাম্মদ খান (কোষাধ্যক্ষ) প্রমুখ। উল্লেখ্য, ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকার সদরঘাটে রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ রাখা হয়। পরে কাউন্সিল অধিবেশনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে দলের আন্তর্জাতিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর মতপার্থক্যের কারণে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। আর মূল দল আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বহাল থাকেন। 

১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড স্থগিত করা হয়। ১৯৬৪ সালে দলটির কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা হয়। এতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান অপরিবর্তিত থাকেন। ১৯৬৬ সালের কাউন্সিলে দলের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দীন আহমদ। এরপরে ১৯৬৮ ও ১৯৭০ সালের কাউন্সিলে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক অপরিবর্তিত থাকেন। এই কমিটির মাধ্যমেই পরিচালিত হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ২০১৬ সালের ২২ ও ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে শেখ হাসিনা সভাপতি পদে বহাল থাকেন। ওবায়দুল কাদের সাধারণ সম্পাদক হন। সর্বশেষ ২৪ ডিসেম্বর ২০২২ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম কাউন্সিলে একই কমিটি বহাল থাকে।

আওয়ামী লীগ শুধু এ দেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারাও। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ইতিহাস এক সূত্রে গাঁথা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ভাষা সংগ্রামের পথ ধরে ৬৬ সালে ৬ দফা, ৬৯-এর গণআন্দোলনসহ দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করে বাঙালি জাতি। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ বাঙালি জাতির যা কিছু শ্রেষ্ঠ অর্জন, তার মূলে রয়েছে জনগণের এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব। জন্মলগ্ন থেকে এখনও পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস জনগণ এবং সংগঠনের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।তবে আওয়ামী লীগের কর্তাব্যক্তিদের মনে রাখতে হবে এই দলের প্রতি জনগণের ভালবাসার মূল কারণ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গুবন্ধুর আদর্শের প্রতি ভক্তি বা আস্থা। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকারে থাকুক আর নাই বা থাকুক কোনও অবস্থাতেই যেন আদর্শ থেকে বিচ্যুতি না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। জয় বাংলা !

লেখক : মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক