একজন রক্তদাতা, এক অনন্য নায়ক

সৈয়দা বদরুন নেসা প্রকাশিত: জুন ১৪, ২০২৪, ০৪:১৬ পিএম

রক্তদান একটি মহান দান, যার মাধ্যমে আমরা অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতে পারি। একটি ছোট্ট পদক্ষেপে একটি প্রাণ বাঁচাতে আমরা সবাই সক্ষম। আজ ১৪ জুন, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হলো স্বেচ্ছায় রক্তদানের গুরুত্ব তুলে ধরা। রক্তদাতাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ও সাধারণ মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করা।

থ্যালাসেমিয়া রোগীসহ অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীর জীবন বাঁচাতে যেসব হৃদয়বান ব্যক্তি স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন, তাদের অবদানের কথা স্মরণ করে আজকের এই দিবসটি উদযাপন করা হয়।

বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের প্রধান লক্ষ্য হল জনগণকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করা, নতুন রক্তদাতা তৈরি করা এবং নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন নিশ্চিত করা। রক্তদান সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এইডস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি এবং অন্যান্য রক্তবাহিত রোগ থেকে মানুষকে সুরক্ষিত রাখা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৪ সাল থেকে ১৪ জুনকে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। যারা স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্তদান করেন, তাদের সম্মান জানাতেই এই দিবসটি পালন করা হয়। বিশেষ করে, থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জীবন বাঁচাতে নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়।

বাংলাদেশে প্রায় ৭০ হাজার থেকে ৯০ হাজার থ্যালাসেমিয়া রোগী রয়েছে, যাদের জীবন রক্ষায় নিয়মিত রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তদাতা ছাড়া তাদের বেঁচে থাকা কল্পনা করা যায় না। প্রতি মাসে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগীর এক থেকে তিন ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হতে পারে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রক্তদান করলে রক্তদাতার স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। রক্তদানের মাধ্যমে দাতার অস্থিমজ্জা থেকে নতুন রক্তকণিকা তৈরির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, যা দাতার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এছাড়া, নিয়মিত রক্তদান করলে উচ্চ রক্তচাপ এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে যায়, ফলে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

রক্তদান করার সময় রক্তে কোনো সংক্রামক জীবাণু আছে কিনা, তা পরীক্ষা করা হয়। ফলে রক্তদাতা তার স্বাস্থ্যের বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারেন। রক্তদানের মাধ্যমে একজন দাতা শুধু একটি প্রাণ রক্ষা করেন না, বরং নিজেও বিভিন্ন শারীরিক উপকারিতা পান।

রক্তদানের জন্য কিছু সাধারণ শর্ত পূরণ করতে হয়। ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যে যে কোনো সুস্থ মানুষ, যাদের ওজন ৪৫ কেজির বেশি, তারা চার মাস অন্তর অন্তর রক্তদান করতে পারেন। রক্তদানের আগে অবশ্যই দাতার রক্ত হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, এইচআইভি বা এইডস, ম্যালেরিয়া এবং সিফিলিস পরীক্ষিত হতে হবে।

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সহায়তায় কাজ করছে বিভিন্ন সংস্থা। যেমন, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতাল, থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল। রক্তদাতারা এসব প্রতিষ্ঠানে নির্ভয়ে রক্ত দিতে পারেন।

বিশ্বজুড়ে রক্তদাতার সংখ্যা প্রতি বছর প্রায় ১১২ মিলিয়ন ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে স্বেচ্ছায় রক্তদানের হার অনেক দেশে বাড়ছে, যা একটি আশাব্যঞ্জক প্রবণতা। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৭ লক্ষ ইউনিট রক্তের প্রয়োজন হয়, যার একটি বড় অংশ স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়।

আসুন, আমরা সবাই মিলে অন্তত এক ব্যাগ রক্ত দান করি এবং একটি প্রাণ বাঁচাই। রক্তদানের মাধ্যমে আমরা মানবতার সেবায় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারি।

রক্তদাতাদের অনুপ্রাণিত করতে এবং রক্তদানের হার বৃদ্ধি করতে আমরা নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নিতে পারি-

জনসচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি: বিভিন্ন মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে রক্তদানের গুরুত্ব তুলে ধরতে প্রচারণা চালানো। প্রতিবছর রক্তদাতাদের সম্মাননা প্রদান, নিয়মিত রক্তদাতাদের উৎসাহিত করতে এবং নতুন রক্তদাতাদের উদ্বুদ্ধ করতে বিশেষ সম্মাননা ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করা।

বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মস্থলে রক্তদান ক্যাম্প: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নিয়মিত রক্তদান ক্যাম্প আয়োজন করা।

অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম: রক্তদাতা এবং রক্তগ্রহীতাদের সংযোগ স্থাপনের জন্য অ্যাপ ও অনলাইন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

স্বাস্থ্য সুবিধা প্রদান: রক্তদাতাদের বিনামূল্যে বা কম খরচে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সুবিধা প্রদান করা।

আসুন, আমরা সবাই মিলে রক্তদানের মাধ্যমে মানবতার সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করি এবং একটি সুন্দর, সুরক্ষিত সমাজ গড়ে তুলি।

লেখক: গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, বরেন্দ্র কলেজ, রাজশাহী