বয়কট বা বর্জনের ইতিহাস শত শত বছরের পুরোনো। তা কখনো রাষ্ট্রীয়, কখনো আন্তর্জাতিক, কখনোবা ধর্মীয় কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে। এই বয়কটের কবলে পড়ে অনেক রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে এটিকে জনগণের ঐক্যের শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তারই উদাহরণ আবার স্পষ্ট হলো বাংলাদেশে। স্বাধীনতাকামী মুসলিম দেশ ফিলিস্তিনের সমর্থনে বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায় কোকা-কোলাসহ ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, যেসব আন্তর্জাতিক কোম্পানি ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বা সরকারকে সমর্থন করে, তাদের পণ্য বয়কটের আহ্বান জানানো হয় বাংলাদেশে। জেনে রাখা ভালো, প্রায় বিশ বছর আগে ইরাকে আমেরিকান আগ্রাসনের সময় আরব দেশগুলোতে আমেরিকান পণ্য বয়কট করা হয়েছিল। সর্বশেষ যে বয়কট প্রচারাভিযান আলোচিত হয়েছিল, সেটি ছিল সুইডেন ও ডেনমার্কের বিরুদ্ধে। ওই দেশ দুটি মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফ পোড়ানোর অনুমতি দিলে আল-আজহারের মতো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এর প্রতিক্রিয়ায় সুইডিশ এবং ড্যানিশ পণ্য বয়কটের আহ্বান জানায়।
ইসলাম ধর্মমতে, অন্যায় কাজের বিরোধিতার মতোই মহানবীর (সা.) অবমাননার বিরোধিতা ও প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও শরীয়তের স্বীকৃত মূলনীতি হলো, সরাসরি বাধা প্রদান ও প্রতিহত করার শক্তি না থাকলে ‘সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবাদ করা’। এর আলোকে প্রত্যেকে যার যার শক্তি-সামর্থ্য অনুযায়ী এ ঘৃণ্য কাজটির বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করবে।
সম্প্রতি কোমলপানীয় কোকা-কোলার বিরুদ্ধে বয়কট বা বর্জনের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশের এক শ্রেণির ধর্মপ্রাণ ভোক্তা। তাদের অভিযোগ, ফিলিস্তিনে হামলাকারী ইসরায়েল এই পণ্যের সমর্থক। তাই তাদের পণ্য বয়কট করতে হবে। গত ঈদুল ফিতরের আগে থেকেই বয়কট ইস্যু চলতে থাকে। তবে ইদানীং কোকা-কোলা কোম্পানির একটি বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে সেই ইস্যু আবার সামনে চলে আসে।
ওই বিজ্ঞাপনের প্রতিবাদ স্বরূপ বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কোকা-কোলা বয়কটের ঘোষণা দেন। ফলে কোম্পানিটি অনেকটা বিপাকেই পড়ে যায়। আবার অনেকেই বয়কটের বিরুদ্ধে অবস্থান পরিষ্কার করেন। এই পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে একটি ঘোলাটে পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞাপনে অভিনয় করার কারণে দুজন অভিনেতাকেও বয়কটের ঘোষণা দেওয়া হয়।
বয়কটকারীদের দাবি, কাউকে কোনো কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য অর্থনৈতিক বয়কট যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি পন্থা। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এ ধরনের পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। তবে ইসলামে যেহেতু মুসলিম-অমুসলিম সবার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য অনুমোদিত, তাই কেউ কেউ দাবি করে থাকেন, ইসলামে বাণিজ্যিক বয়কটের কোনো ভিত্তি নেই; এটি ইসলামের মূল শিক্ষার সঙ্গে যায় না। ফলে বিষয়টি নিয়ে কারও কারও মনে সংশয়ের সৃষ্টি হয়। অমুসলিমদের সঙ্গে (স্বদেশি বা ভিনদেশি) সব ধরনের বৈধ বেচাকেনা ইসলামে অনুমোদিত। রাসুল (সা.) মদিনার ইহুদিদের সঙ্গে ব্যবসায়িক লেনদেন করতেন। একইভাবে বাইরে থেকে আসা জনৈক পৌত্তলিক বণিকের কাছ থেকে ছাগল কিনেছেন এমন বর্ণনাও এসেছে হাদিসে। তবে যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কাঁচামাল এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কাজে আসে এমন সব বস্তু অমুসলিমদের কাছে বিক্রি করা হারাম।
এ থেকে ইসলামি শরিয়তের একটি মূলনীতি স্পষ্ট হয়। তা হচ্ছে, যে ব্যবসায়িক লেনদেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত কাফের গোষ্ঠীকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে, তা জায়েজ নয়। সুতরাং যেসব কোম্পানি ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে অর্থ সরবরাহ করে অথবা মুসলমানদের ওপর জুলুম-নির্যাতনে সহযোগিতা করে, প্রতিবাদস্বরূপ তাদের পণ্য বর্জন করা শুধু বৈধই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে মুসলমানদের ইমানের দাবিও বটে। ফলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম এলাকায় ব্যবসা করা খুবই কঠিন। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কোকাকোলা বয়কট না করলেও বাংলাদেশ কিন্তু বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, কোকা-কোলার বোতলেও ‘উই সাপোর্ট প্যালেস্টাইন’ লিখে বাজারজাত করা হয়েছে। কোনো কোনো আউটলেটে এমন লেবেলযুক্ত বোতল দেখা গেছে বলে দাবি কারো কারো।
তবে একটি বিষয় মনে রাখার মতো, কোকা-কোলা কোম্পানির আরও তিনটি পানীয় রয়েছে। যেমন স্প্রাইট, ফ্যান্টা ও কিনলে। ওই তিনটি পণ্যকে কিন্তু বয়কট করা হয়নি। কারণ ওই তিনটি পণ্য বাংলাদেশে এতটা জনপ্রিয় নয়। এছাড়া কোক স্টুডিও বাংলার মতো সংগীত বিষয়ক একটি প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। সেটিও বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়। আর কোকা-কোলা বাংলাদেশের বাজারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ব্যবসা করে আসছে শত বছর ধরে। ফলে কোনো একটি মহল ধর্মীয় ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে কোকা-কোলাকে বেকায়দায় ফেলতে চাইতেই পারে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আমরা জানি, বিভিন্ন ইস্যুতেই বিভিন্ন সময়ে বয়কট বা বর্জন কর্মসূচি পালিত হয়ে আসছে। বাজারে দাম বেড়ে গেলে বাংলাদেশে তরমুজ বয়কট করেছিল জনগণ। গরুর মাংসও বয়কট করেছিল কিছুদিন। সুতরাং জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে মাথায় রেখে ব্যবসা করতে হয়। কোকা-কোলা যদি তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে, তাহলে হয়তো হৃত গৌরব ফিরে পাবে। তারপরও সাময়িক বয়কটে তাদের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তা ফিরে পাবে না কখনোই। তাই মানুষের আবেগ-অনুভূতি নিয়ে খেলা করে বাণিজ্য সম্ভব নয়। ভোক্তার মনোজাগতিক দর্শন আগে বুঝতে হবে।
গণমাধ্যম সূত্রে জেনেছি, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কোকা-কোলা কোম্পানি বাংলাদেশকে কিনে নিয়েছে তুরস্কের একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সিসিআই (কোকা-কোলা আইসেক)। তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ১২টি মুসলিম দেশে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভিন্নতর পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। তারা যদি কৌশল পাল্টাতে পারে। বা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের সহমর্মিতা ফুটিয়ে তুলতে পারে, তবেই বাংলাদেশে কোকা-কোলা পুনরায় ক্রেতা ফিরে পেতে পারে। এখন তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা বাংলাদেশে কোন পদ্ধতিতে ব্যবসা করবেন।
এ কথা সত্য যে, যারা মনেপ্রাণে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন, তাদের ফেরানো খুব সহজ কাজ হবে না। কারণ তারা ধর্মকে অন্তরে লালন করেন। তাদের বিশ্বাস অর্জন করা কঠিন হবে। তাই কোকা-কোলার বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণায় অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাদের নমনীয় হতেই হবে। জোর করে যেমন ভালোবাসা আদায় করা সম্ভব নয়; তেমনই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে ক্ষেপিয়েও বাজার ধরে রাখা সহজ নয়। ফলে কৌশলগত পরিবর্তনই কেবল তাদের ক্ষতিকে প্রশমিত করতে পারে। মানবকল্যাণে ভূমিকা রাখতে হবে। আদর্শগত বিষয় থাকলেও ব্যবসার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। কোকা-কোলা যদি তাদের বিক্রিত অর্থ থেকে ফিলিস্তিনকে সাহায্য করে, তবেই হয়তো হৃত গৌরব ফিরে পাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক