বাহরাইন থেকে ইসরায়েলের এইলাত বন্দরে যে হামলা হয়েছে তা নতুন ডাইমেনশন। পুরো মধ্যপ্রাচ্য ইসরায়েলের জন্য আগুনের কুণ্ডলীতে পরিণত হচ্ছে। খুব নিকট ভবিষ্যতে সৌদি আরব ও জর্ডান থেকে যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা হয় তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। পরিস্থিতি আসলেই অনেক বদলে গেছে এবং দ্রুত আরও পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
লক্ষ্য করুন, বাহরাইনে মার্কিন পঞ্চম নৌবহরের ঘাঁটি রয়েছে। এ ছাড়া ট্রাম্পের শেষ সময়ে ইসরায়েলের সাথে যেসব দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি গ্রহণ করেছে, বাহরাইন তার অন্যতম। বাহরাইন হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ব্লকের অন্যতম প্রধান দেশ। গাজার চলমান সংঘাত-যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতি দেশটির মোটেই দরদ-ভালোবাসা থাকার কোনো কারণ দেখি না। কিন্তু সেই দেশ থেকে একটা প্রতিরোধকামী গ্রুপ জেগে উঠেছে এবং ইসরায়েলের এইলাত বন্দরে হামলা চালিয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা নতুন ডাইমেনশন। মধ্যপ্রাচ্যে অনেক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত।
আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে দেখি তবে দেখব, ২০১১ সালে যখন তিউনিসিয়া এবং মিশরে গণজোয়ার সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের বিপ্লব হয়ে গেল এবং তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক বেন আলী আর মিশরের স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে গেলেন, তখন সেই গণজোয়ার ছড়িয়ে পড়ল পুরো উত্তর আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে। স্বৈরতান্ত্রিক আর রাজতান্ত্রিক শাসকদের দীর্ঘদিনের যত্নে সুপ্রতিষ্ঠিত ক্ষমতার মসনদ দারুণভাবে কেঁপে উঠলো। সেই গণ-বিপ্লবের ঢেউ এই বাহারাইনেও লেগেছিল। বাহরাইনে এতটাই উত্তাল তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল যার সামনে দেশটির রাজতান্ত্রিক শাসক হামাদ বিন ঈসা আলে খলিফার টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। একইভাবে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় এবং শিয়া অধ্যুষিত কাতিফ প্রদেশে। সেই আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আয়াতুল্লাহ শেখ নিমর আল নিমর, যাকে ২০১৬ সালে সৌদি সরকার নানা অজুহাতে মৃত্যুদণ্ডের নামে হত্যা করে। ইয়েমেনেও আন্দোলনের প্রচণ্ড ঢেউ আছড়ে পড়ে। তখন সেই সমস্ত আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিয়ে একটি মাত্র দেশে গিয়ে সরকার পরিবর্তনে চক্রান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়। সেই দেশটি হচ্ছে সিরিয়া।
মধ্যপ্রাচ্যের জাগরণের নাম ততক্ষণে ‘আরব বসন্ত’ (Arab Spring) হয়ে গেছে। এটা পশ্চিমাদের দেওয়া একটি নাম। সমস্ত দেশ থেকে এই আরব বসন্তের গতিপথ পরিবর্তন করে সিরিয়ায় নিয়ে গিয়ে ঠেকানো হয় এবং আমেরিকা, ইসরাইল ও তুরস্কসহ বহু দেশের চোখে মধ্যপ্রাচ্যের ‘প্রধান স্বৈরশাসক’ বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত করা হয়। মজার বিষয় হলো, রাজতান্ত্রিক দেশগুলোর শাসকরা কোনো সমস্যায় ছিল না; পশ্চিমাদের চোখে তখন আসাদ যতবড় স্বৈরশাসক সম্ভবত পৃথিবীতে ততবড় স্বৈরশাসক আর কেউ ছিল না। এর মূল কারণ, ওই ইসরাইলের নিরাপত্তা এবং ‘নিউ মিডল ইস্ট প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করার চক্রান্ত। কিন্তু বিশ্ববাসীকে বোঝানো হলো স্বৈরশাসক আসাদকে উৎখাত করে সিরিয়ায় ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হবে মুসলিম ব্রাদারহুডের শাসন। এরদোয়ান খলিফার অনুসারীদের চোখমুখ তখন খুশিতে ডগমগ করছে; তারা মুসলিম ব্রাদারহুডের শাসন পাবেন, কত দিনের লালিত স্বপ্ন তাদের! আহা…
যাহোক, আরব বাসন্তে সৌদি আরব ও বাহরাইনসহ আরব বিশ্বে একেবারে প্রতিষ্ঠিত রাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে যে পরিবর্তনের আওয়াজ উঠেছিল সেই আওয়াজকে স্তিমিত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বাহারাইনে ২০১১/১২ সালের দিকে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে হামাদ বিন ঈসা-আলে খলিফার রাজতান্ত্রিক সরকারের বিদায় নিতান্তই সময়ের ব্যাপার। কিন্তু সৌদি আরব ও আমেরিকাসহ পশ্চিমা শক্তি মিলে বাহরাইনের শাসককে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে। এজন্য বিপ্লবী ও বিরোধীদের ওপর চালাতে হয় নির্যাতনের স্টিমরোলার। অন্যদিকে, সিরিয়ার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সমস্ত শক্তি নিয়োগ করা হয়। শুধু তাই নয়, বাসার আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের নেতৃত্বে ‘ফ্রেন্ডস অব সিরিয়া’ নামের একটি ফোরাম গঠন করা হয়, যে ফোরামের অন্তত দুটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তুরস্কে। পরবর্তীকালে আইএস ও উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আল-শামসকে লেলিয়ে দিয়ে কী করা হয়েছে সিরিয়ায়, আমরা সবাই তা জানি।
যাইহোক, বাহরাইনের জনগোষ্ঠীর প্রায় শতকরা ৭০ ভাগের কাছাকাছি শিয়া মুসলমান, যাদের ওপর রয়েছে ইরানের বিরাট প্রভাব। বাহরাইনের অবস্থান হচ্ছে পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ উপকূলে এবং ইরানের ঠিক বিপরীতে। এই বাহরাইনেই রয়েছে মার্কিন সামরিক বাহিনীর পঞ্চম নৌ বহরের ঘাঁটি। আগেই বলেছি, ইসরায়েলের সাথেও বাহরাইনের রয়েছে একবারে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক। ফলে, এই দেশটি থেকে ইসরায়েলের ওপর হামলা এখনো কল্পনার বিষয়। অসম্ভবও বটে। তারপরেও হামলা হয়েছে, এটাই বাস্তবতা।
ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাচ্ছে লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেন থেকে হুথি সমর্থিত সেনারা, ইরাক থেকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জোট পপুললার মোবিলাইজেশন ইউনিট বা পিএমইউ। সিরিয়াতে গড়ে উঠেছে আরও এক দল প্রতিরোধকামী যোদ্ধা। এছাড়া, ফিলিস্তিনের মাটিতে হামাস এবং জিহাদ আন্দোলনসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিরোধকামী দল গড়ে উঠেছে, যাদের পেছনে সরাসরি ইরানের মদদ রয়েছে। সর্বোপরি ইরান থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক হামলা চালানো হয়েছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় শক্তি জড়িত।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে এই যে প্রতিরোধগমী সংগঠনগুলো গড়ে উঠেছে, যারা আমেরিকা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে তারা আসলে সবাই ইরান দ্বারা সমর্থিত। এর মধ্যে বাহারাইন থেকে যে প্রতিরোধকামী সংগঠনটি ইসরায়েলের ওপর হামলা চালিয়েছে সেটি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। বাহারাইনের ওপরে অর্থাৎ দক্ষিণে ও পশ্চিমে সৌদি আরব। শিয়া অধ্যুষিত এই বাহরাইনের কাছের সৌদি প্রদেশ হচ্ছে কাতিফ, যেখানে শিয়া সম্প্রদায়ের ব্যাপক আধিপত্য রয়েছে এবং তাদের সাথে ইরানের খুবই ভালো সম্পর্ক। এই ভালো সম্পর্কের জের ধরে ইরান কাতিফ প্রদেশে একইভাবে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের দল গড়ে তুলতে পারে।
ওপাশে ইরাকে যখন ইসরায়েল-বিরোধী সংগঠন গড়ে উঠেছে তখন ইরাকের দক্ষিণ সীমান্ত পেরোলেই জর্ডান; যেখানে ইসরায়েল-বিরোধী সংগঠন গড়ে ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। সবকিছু মিলে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি দিন দিন ইসরায়েলের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে, আর ইরান এবং তার নেতৃত্বাধীন রেজিস্ট্যান্স ফোর্স অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে চলেছে। সে ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের টিকে থাকা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে, নিকট ভবিষ্যতে তা আরও বেশি জটিল ও কঠিন হবে।
মধ্যপ্রাচ্যের আজকের এই অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করতে ইরানের দীর্ঘদিন সময় লেগেছে। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে আজকের এই অর্জন। এ অবস্থা তৈরি করার জন্য ইরানকে যেমন ক্ষুরধার কূটনীতি পরিচালনা করতে হয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে আলাদা রকমের সক্ষমতা তৈরি করতে হয়েছে। ইরান নিজে যেমন হরমুজ প্রণালীর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি নৌ রুট নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি তারা ইয়েমেনে নিজেদের আধিপত্য ও প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে হুথিদের গড়ে তুলেছে। এই হুথিরা নিয়ন্ত্রণ করছে হরমুজ প্রণালীর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ নৌ রুট বাব আল-মান্দেব প্রণালী। আবার একেবারে ইসরাইল সীমান্তে গড়ে তুলেছে হিজবুল্লাহর মতো ঝানু ও লড়াকু একটি সংগঠন। একইভাবে ইসরায়েল সীমান্তে রয়েছে সিরিয়ার মতো রাষ্ট্রীয় শক্তি যারা ইরানের সাথে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখে। আর ইসরায়েলের একেবারে পেটের ভেতরে জন্ম নিয়েছে হামাস এবং জিহাদ আন্দোলন। ফলে ১৯৭৯ সাল থেকে ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে যে লড়াই শুরু হয়েছিল সেই লড়াইয়ে ইরান এখন চূড়ান্তভাবে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েল ভীষণভাবে অস্তিত্বের সংকটে। সম্ভবত সে সময় আর বেশি দূরে নয় যখন ইসরায়েল এবং ইরানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হিসাব নিকাশ হবে। সেই হিসাব-নিকাশে একেবারে মার্কিন প্রভাব বলয়ে থাকা বাহরাইনের মতো দেশও ইসরায়েল-বিরোধী একটি শক্ত ঘাঁটি হয়ে উঠতে পারে। বাহরাইন থেকে ইসরায়েলে আল-আশতার গ্রুপের হামলা তারাই ইঙ্গিত।
লেখক: সাংবাদিক ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক