অনতি অতীত-বহমান বর্তমান-অনিশ্চিত ভবিষৎ। সময়ের এই তিন স্টাম্পের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বেকাপের স্বপ্ন। জিম্বাবুয়ে-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা তিনটা সিরিজ জয়। সেই জয়ের সুবাস মরুর বুকে উবে গেল স্কটিশ-ঝোড়ো বাতাসে! স্কটল্যান্ডের কাছে ৬ রানের হার। তাতে যেন হারিয়ে গেছে নিজেদের সম্পর্কে অর্জিত এবং অধীত আত্মবিশ্বাস! একটা হারের পরই সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হচ্ছেন ক্রিকেটাররা। বিধ্বস্ত দলকে ক্ষত-বিক্ষত আর রক্তাক্ত করা হচ্ছে তীব্র সমালোচনার হাতুড়ির আঘাতে!
স্কটল্যান্ডের কাছে হার! এমন হয়? হতে পারে? কখনো হয়েছে এই ক্রিকেট বিশ্বে! হয় কারণ, খেলাটার নাম ক্রিকেট। স্কটিশদের বীরত্বকে আপনি অস্বীকার করবেন কেন! এই ম্যাচটাতে স্কটিশরা শিখিয়ে দিল, জীবনে কখনো হাল ছাড়তে নেই। ক্রিকেটে খাদের কিনার থেকেও ঘুরে দাঁড়ানো যায়। ম্যাচ জেতা যায়। হারতে হারতেও শেষ র্পযন্ত স্কটল্যান্ড ম্যাচটা জিতেছে। আর বাংলাদেশ জিততে জিততে হেরেছে! তাই অবিমিশ্র শোক-তাপ-দুঃখ-হতাশা-বেদনার প্রকাশ দেশের মানুষের কথায়, অভিব্যক্তিতে। কারণ, দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী কোটি কোটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, স্বপ্নদ্রষ্টা বাঙালির জয়ধ্বজা—ক্রিকেট।
স্কটল্যান্ডের জয় আপনার কাছে’ অঘটন’! স্কটল্যান্ডের কাছে এই হার চিন্তাও করা যায় না! এমন মন্তব্য স্বয়ং বিসিবি সভাপতির। তাহলে একটু ভেবে দেখুন, ঢাকার মাঠে স্লো আর লো বাউন্সি উইকেটের প্রেসক্রিপশন দিয়ে যখন অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে বাংলাদেশ হারাল সেটা কী ছিল? ’অঘটন’ নাকি ’রূপকথা’। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি বা নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের প্রেসিডেন্ট কী বলেছেন, ‘এটা চিন্তাই করা যায় না! মেনে নেওয়া যায় না?’ গণমাধ্যমে তেমন কিছু চোখে পড়েনি। আসলে আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতি বড় অদ্ভুত! একটা ম্যাচ জিতলেই অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়া হয় ক্রিকেটারদের। সেই জোয়ারে ক্রিকেটাররা যতটা ভাসেন তার চেয়ে আগে ভাসতে চান বোর্ড কর্তারা! একটা ম্যাচ জয়, একটা সিরিজ জয়ের পাশাপাশি পরাজয় মেনে নেওয়ার শিক্ষাটাও ক্রিকেটারদের থাকে। পেশাদারত্বের অংশ সেটা। পেশাদার ক্রীড়াবিদরা নিজেদের মানসিকতা সেভাবেই তৈরি করেন। কিন্তু মানসিকতার বদল হয়নি ক্রিকেট কর্তা থেকে ক্রিকেট প্রশাসনের সবোর্চ্চ ব্যক্তিদের। হারলেই সব শেষ—এই দীর্ঘশ্বাস ফেলার আগে একবার ভাবুন, এই ক্রিকেটাররাই আপনাদের কত সুখকর অনুভূতির জন্ম দিয়েছেন। কত ছবি। কত ক্রিকেটীয় বীরত্বের ইতিহাস আর কত অনন্য জাতীয় মুহূর্ত তৈরি করেছেন তারা।
স্কটল্যান্ডের কাছে হারের পর বিধ্বস্ত দলটার কাছে গিয়ে কেউ কি বলেছেন, ‘একটা ম্যাচ হেরেছ, তাতে কী হয়েছে? সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। উঠে দাঁড়াও। নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখে ওমানের বিপক্ষে জয়ের জন্য ঝাঁপাও। তোমরা পারবে।’ কে বলবেন এই কথাগুলো! যাদের বলার কথা তারা তো উল্টো বলছেন, ‘এই হার চিন্তাই করা যায় না!’
প্রচণ্ড চাপ সামলানোর স্নায়ুসম্পন্ন বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার আছেন বাংলাদেশ দলে। সে কারণে তারা তারকা। আলো ছড়ানোর ক্ষমতা তাদের আছে। পরের ম্যাচে ওমানের বিপক্ষে আলাদা আলোর বিচ্চুরণ ঘটবে না, সেটা কে বলতে পারেন?
তবে একটা কথা বলা যায়, ওমান বাংলাদেশের মতো দলের বিপক্ষে নিজেদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন। এবং সতর্ক। আগের ম্যাচে জয়ের মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া আত্মবিশ্বাস বাড়তি অুনপ্রেরণা জোগাবে। আর বাংলাদেশ দলটা বিশ্বাসহীন আনফিট হয়ে পড়ছে অতিসমালোচনার ধাক্কায়। সেটা দেশ আর দেশের ভেতর থেকেই। বাংলাদেশ দলটা যদি স্কটিশদের কাছে হারে শোকদগ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ওমানের বিপক্ষে জ্বলে উঠবে কীভাবে! আর এ ম্যাচ জিততে না পারলে বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলার স্বপ্নটা পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ওমানে যদি বাংলাদেশের স্বপ্ন পোড়ে, তাহলে মাসকাটের আকাশে ধোঁয়া উড়বে। সেই ধোঁয়ার মাঝে তৈরি হবে বিশাল শূন্যতা। আর সেই স্বপ্ন পোড়া ছাই কফিনবন্দী করে ফিরতে হবে ঢাকায়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজা-দুবাই-আবুধাবিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল র্পবে আর খেলা হবে না তাদের।
তবে শেষ বাক্যটা এখনই লেখা যাচ্ছে না। ক্রিকেটেও জীবনের মতো অনেক কিছু ঘটে। যুক্তি, বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না। বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বপ্নটা অনিশ্চয়তায় ঢাকা পড়েছে ঠিকই। কিন্তু স্বপ্ন অস্তরাগে তা বলা যাচ্ছে না। পারফরম্যান্সের আলোকছটায় সেটা আরও উজ্জ্বল হতে পারে আজই। আর জিততে না পারলে তা হবে অসম্ভব দুঃখের। কিন্তু মর্মান্তিক নয়।
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক